বাঙালি জাতির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাঙালি জাতির মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ভাষা ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিত রচিত হয়েছিল।

২১ ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দেওয়া এক বাণীতে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনের জন্য বারবার কারাবরণ করলেও তার অবদান ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান, সেই অবদানটুকু কিন্তু মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। অনেক বিজ্ঞজন, আমি কারো নাম বলতে চাই না, চিনি তো সবাইকে। অনেকে বলেছেন, ওনার আবার কী অবদান ছিল? উনি তো জেলেই ছিলেন।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন বলে উনার কোন অবদান নেই? তাহলে উনি জেলে ছিলেন কেন? এই ভাষা আন্দোলন করতে গিয়েই তো তিনি বারবার কারাগারে গিয়েছেন। সেই গুরুত্ব কিন্তু কেউ দিতে চায়নি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ভাষা মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন সূচনা করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারই উদ্যোগে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং আমাদের ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অর্জন।

আরও পড়ুন…১৯ ব্যক্তি ও দুই প্রতিষ্ঠানকে একুশে পদক প্রদান

পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রিপোর্টে বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনে অবদানের কথা উল্লেখ আছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ইন্টেলিজেন্স রিপোর্টগুলো পাওয়ার পরে আমি একটা ভাষণ দিয়েছিলাম। তখন একজন বিদগ্ধ জন আমাকে খুব ক্রিটিসাইজ করে একটা লেখা লিখলেন যে, আমি নাকি সব বানিয়ে বানিয়ে বলছি।

তিনি বলেন, গোয়েন্দা রিপোর্টগুলো নিয়ে আমি আর আমার বান্ধবী বেবি মওদুদ, এম আর আক্তার মুকুলের কাছে যাই। মুকুল ভাইকে বললাম আপনার কাছে এই যে সমস্ত রিপোর্ট দিলাম, কোন তারিখে কখন কি করেছেন এখানে সব বিস্তারিত আছে। ফাইলটা দিলাম; আপনি এর জবাবটা লিখুন। তিনি সত্যিই লিখেছিলেন। কারণ, ওনারাতো (সমালোচক) অনেক উঁচু মাপের লোক।

আমাদের মত ছোট চুনোপুটিরা কিছু লিখলে তো হবে না সে জন্য। পরে অবশ্য সেগুলো ১৪ খন্ডের পুস্তক আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি জাতির পিতার লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও তাঁর ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ভূমিকার উল্লেখ রয়েছে বলেও তিনি জানান।

‘বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার একটা প্রবণতা সব সময় ছিল’, উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর দেখা গেল আমাদের সেই মহান মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, যে স্লোগান দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে, সেই জয়বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ।

৭ মার্চের ভাষণ, যে ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের সমস্ত নির্দেশনা এবং সে ঐতিহাসিক কথা ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, রেডিওতে প্রতিদিন এই বার্তাটা পৌঁছানো হতো। এই ভাষণের কারণে মুক্তিযোদ্ধারা যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন। সেই ভাষণটাও নিষিদ্ধ। আসলে বঙ্গবন্ধুর নামই তো মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল।

এ বছর ভাষা আন্দোলন ক্যাটাগরিতে তিনজন, মুক্তিযুদ্ধে একজন, শিল্পকলায় আটজন (অভিনয়, সঙ্গীত, আবৃত্তি, চারু ও চিত্রকলা), রাজনীতিতে দুইজন, শিক্ষায় একজন ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠান, সমাজ সেবায় একজন ও একটি প্রতিষ্ঠান এবং সাংবাদিকতা, গবেষণা এবং ভাষা ও সাহিত্যে একজন করে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন।

ভাষা আন্দোলন ক্যাটাগরিতে খালেদা মঞ্জুর-ই খুদা, বীর মুক্তিযোদ্ধা একেএম শামসুল হক (মরণোত্তর) এবং হাজী মোহাম্মদ মজিবুর রহমান। শিল্পকলা বিভাগে অভিনয় ক্যাটাগরিতে মাসুদ আলী খান ও শিমুল ইউসুফ এবং সংগীত বিভাগে মনোরঞ্জন ঘোষাল, গাজী আবদুল হাকিম ও ফজল-এ-খোদা (মরণোত্তর), আবৃত্তি বিভাগে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, শিল্পকলায় নওয়াজিশ আলী খান এবং চিত্রকলা বিভাগে কনক চাঁপা চাকমা পুরস্কার পেয়েছেন।

আরও পড়ুন…সাধারণের চলাচলে খুলে দেয়া হলো কালশী ফ্লাইওভার

মুক্তিযুদ্ধ বিভাগে মমতাজ উদ্দিন (মরণোত্তর), সাংবাদিকতায় মো. শাহ আলমগীর (মরণোত্তর), গবেষণায় ড. মো. আব্দুল মজিদ, শিক্ষায় অধ্যাপক ড. মযহারুল ইসলাম (মরণোত্তর), সমাজসেবায় মো. সাইদুল হক, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইসলাম (মরণোত্তর) এবং রাজনীতিতে আকতার উদ্দিন মিয়া (মরণোত্তর) এবং ভাষা ও সাহিত্যে ড. মনিরুজ্জামান পুরস্কার পেয়েছেন। শিক্ষা ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর এবং সমাজসেবায় বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এ পুরস্কার লাভ করেছে।

পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেককে স্বর্ণপদক, সম্মাননা সনদ এবং চার লাখ টাকার চেক প্রদান করা হয।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে আমাদের আসতে হয়েছে, এখনকার প্রজন্ম যার অনেক কিছু জানেও না।
তিনি বলেন, উর্দ্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টা, রোমান ও আরবি হরফে বাংলা লেখানোর প্রচেষ্টা এমনকি রবীন্দ্র সঙ্গীতও অন্যদের দিয়ে লেখানোর প্রচেষ্টা বাঙালি দেখেছে, কিন্তু আমরা তখন আন্দোলন করেছি সকলে মিলে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্রসহ সারা বাংলাদেশে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে এবং এভাবেই আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম আরো দানা বেঁধেছে। আর সেই সংগ্রামের মধ্যদিয়েই আমরা জাতির পিতার নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতাও অর্জন করেছি।

ভাষা ও সাহিত্যের ওপর এমন বার বার আঘাত আর কোন দেশে এসেছে বলে তাঁর জানা নেই উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, অনেক দেশে যুদ্ধের মধ্যেও তাদের সাহিত্য সংস্কৃতি চলমান থাকে। ব্রিটিশ এবং ফ্রান্সের মধ্যে সারাজীবন শত্রুতা চললেও তাদের আর্ট, কালচার ও ভাষা-সাহিত্যচর্চা কোনদিনই বন্ধ ছিল না। কিন্তু, আমাদের পাকিস্তান নামের একই দেশে বাঙালিদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর বার বার আঘাত এসেছে।

ইবাংলা/টিএইচকে

অপরিসীমগুরুত্বভাষা আন্দোলনের