ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের মধ্যে নামাজের পরই জাকাতের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনুল কারিমের বহু স্থানে নামাজের পাশাপাশি জাকাত আদায়ের কথা বলা হয়েছে।
আরবি জাকাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো পবিত্র করা, বৃদ্ধি পাওয়া (বস্তুত জাকাত দিলে মাল পবিত্র হয় এবং বৃদ্ধি পায়)
পারিভাষিক অর্থ
কোনো অসচ্ছল গরীব মুসলমানকে বা মুসলমানদেরকে কোনো প্রকার বিনিময় ও শর্ত ছাড়া যেসব মালের উপর জাকাত প্রযোজ্য ঐ মালের (বর্তমান বাজারের বিক্রয় মূল্যের) চল্লিশ ভাগের এক অংশের মালিক বানানো। (আদ্দুরুল মুখতার ২:২৫৬)
জাকাত আদায়ের হুকুম ও তরককারীর পরিণতি
জাকাত ইসলামের একটি অন্যতম রুকন, নির্দিষ্ট পরিমাণ নির্দিষ্ট সম্পদের মালিকের জন্য জাকাত আদায় করা ফরজ। জাকাত অস্বীকার করলে ঈমান চলে যায়। জাকাতের ফরযিয়্যাত স্বীকার করে আদায় না করা হারাম ও কবিরা গুনাহ।
যারা জাকাত আদায় করবে না তাদের সম্পর্কে কোরআন হাদিসে অনেক কঠোর শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন- সূরা তাওবায় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ كَثِيرًا مِّنَ الْأَحْبَارِ وَالرُّهْبَانِ لَيَأْكُلُونَ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَيَصُدُّونَ عَن سَبِيلِ اللَّهِ ۗ وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ
অর্থ: ‘হে ঈমানদারগণ! পন্ডিত ও সংসারবিরাগীদের অনেকে লোকদের মালামাল অন্যায়ভাবে ভোগ করে চলছে এবং আল্লাহর পথ থেকে লোকদের নিবৃত রাখছে। আর যারা স্বর্ণ ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা ব্যয় করে না আল্লাহর পথে, তাদের কঠোর আজাবের সুসংবাদ শুনিয়ে দিন’। সূরা: তাওবা, আয়াত:-৩৪)
এর পরের আয়াতেই আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন- يَوْمَ يُحْمَىٰ عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَىٰ بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ ۖ هَـٰذَا مَا كَنَزْتُمْ لِأَنفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنتُمْ تَكْنِزُونَ
অর্থ: ‘সে দিন জাহান্নামের আগুনে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তার দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশকে দগ্ধ করা হবে (সেদিন বলা হবে), এগুলো যা তোমরা নিজেদের জন্যে জমা রেখেছিলে, সুতরাং এক্ষণে আস্বাদ গ্রহণ কর জমা করে রাখার’। (সূরা: তাওবা, আয়াত: ৩৫)
আরও পড়ুন>> পবিত্র শবে কদর আজ
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার মালের জাকাত আদায় করে না কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তার গলায় সেই মালকে সাপ বানিয়ে ঝুলিয়ে দেবেন। অন্য এক হাদিসে আছে যে, সাপ তার দুই চোয়ালে দংশন করতে থাকবে এবং বলবে আমি তোমার মাল, আমি তোমার সঞ্চয়। (তিরমিযী হাঃ নম্বর: ২৪৪১, ইবনে মাজাহ হাদিস নম্বর ১৭৮৪)
এছাড়াও বিভিন্ন হাদিসে আরো অনেক শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে।
জাকাত যোগ্য সম্পদ ও জাকাতের নিসাব
ঋণ ও মৌলিক প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ কিংবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য, অথবা ৫২.৫ তোলার রূপার মূল্য সমপরিমাণ নগদ টাকা বা ব্যবসায়ের মালের মালিক হলে চল্লিশ ভাগের এক ভাগ বা শতকরা আড়াই টাকা হারে যাকাত আদায় করতে হয়। (আলমগীরী ১:১৮৭-১৯২)
উল্লেখ্য যেকোনো প্রকার সম্পদ স্বতন্ত্রভাবে নেসাব পরিমাণ না হয়ে একাধিক প্রকারের অল্প অল্প হয়ে সমষ্টিগতভাবে মূল্য হিসাবে ৫২.৫ তোলার মূল্য সমপরিমাণ হলেও জাকাত প্রযোজ্য হবে। (আল বাহরুল রায়েক ২:৪০০,৪০১)
জাকাত যার উপর ফরজ
সাবালক সজ্ঞান মুসলমান নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়ার পর চন্দ্র মাস হিসেবে এক বছর অতিবাহিত হলে তার উপর জাকাত আদায় করা ফরজ হয়।
একই পরিবারে একাধিক ব্যক্তি (যেমন, স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে) নেসাবের মালিক হলে প্রত্যেককেই স্বতন্ত্রভাবে জাকাত আদায় করতে হবে। নেসাবের মালিক প্রত্যেকের উপরই জাকাত আদায় করা ফরজ। স্ত্রীর জাকাত স্বামীর উপর বর্তায় না, তেমনিভাবে সন্তানদের জাকাত পিতার উপর বর্তায় না। তবে কেউ যদি অন্যের অনুমতিক্রমে তার পক্ষ থেকে জাকাত দিয়ে দেয় তাহলে জাকাত আদায় হয়ে যাবে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ঈদ হতে পারে ২২ এপ্রিল
জাকাত যাকে দেবেন
যাদের সঙ্গে দাতার জন্মগত সম্পর্ক আছে যেমন- তার পিতা মাতা, দাদা, দাদী, নানা, নানী, প্রমুখ এবং দাতার সঙ্গে যাদের জন্মগত সম্পর্ক আছে যেমন- তার ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনী ইত্যাদি তাদেরকে জাকাত ফিতরা দেওয়া যায় না।
অনুরূপ ভাবে স্বামী তার স্ত্রীকে, স্ত্রী তার স্বামীকে জাকাত ফিতরা দিতে পারবে না। অমুসলিম ও ধনী ব্যক্তি (নেসাব পরিমাণ মালের মালিক) কিংবা ধনীর নাবালেগ সন্তানকে দান করলেও জাকাত ফিতরা আদায় হবে না। বরং জাকাত ফিতরা দিতে হবে এমন গরীব ও ফকির মিসকীনকে যাদের নিকট নিসাব পরিমাণ মাল নেই।
ধর্মীয় খিদমতে রত নিঃস্ব দরিদ্র ব্যক্তিবর্গকে জাকাত ফিতরা দান করলে ধর্মীয় খিদমতের সহযোগিতা হিসেবে অধিক সওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ২৭৩)
জাকাত যখন আদায় করতে হয়
জাকাত ওয়াজিব হওয়ার সময় যদি রমাজান মাস না হয়ে অন্য কোনো মাস হয় তাহলে সে মাসেই যথা তারিখে সমুদয় মালের হিসাব নিকাশ করে জাকাতের পরিমাণ বের করা জরুরি। আদায়ের ক্ষেত্রেও রমাজানের অপেক্ষা না করে সঙ্গে সঙ্গে আদায় করে দেওয়া জরুরি। যাতে রমাজানের পূর্বে ইন্তেকাল হয়ে গেলে ফরজ জিম্মায় বাকী না থেকে যায়। দেরি করে আদায় করলে যদিও জাকাত আদায় হয়ে যায়। কিন্তু ওয়াজিব তরক করার দরুন গুনাহগার হতে হয়। তবে নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়ার পর বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার পূর্বেই যদি জাকাত আদায় করে দেয় তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। জাকাত আদায় হয়ে যাবে। (কিফায়াতুল মুফতী ৪:২৬২, আলমগীরী ১:১৮৭-১৯২)
ইবাংলা/এসআরএস