বাংলাদেশকে তিস্তা ও গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে মমতা ব্যানার্জ্জীর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছে।
প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মধ্যে যে মনোমালিন্য শুরু হয়েছে, তাতে মমতা ব্যানার্জ্জীকে দায়ী করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।
রাজ্য সরকারকে অন্ধকারে রেখে কেন্দ্র পানি বিক্রি করতে চাইছে মমতার এই অভিযোগকে ‘মিথ্যা দাবি’ বলে দাবি করেছে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার।
গত ২২ জুন দুই দিনের ভারত সফর শেষে ঢাকায় ফেরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করার পর ভারতে কোনো সরকার প্রধানের এটিই ছিল প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর।
প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও একান্ত বৈঠক করেন। শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদির বৈঠক নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দুই দেশের ঐতিহাসিক বন্ধন আরও গভীর করার লক্ষ্যে আলোচনা করেছেন দুই সরকারপ্রধান।
এই আলোচনায় উন্নয়ন অংশীদারত্ব, জ্বালানি, পানিসম্পদ, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ আরও বেশ কয়েকটি বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আরও পড়ুন…বর্তমান প্রজন্মকে স্মার্ট নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ছাত্রলীগের প্রতি আহ্বান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সফরের রেশ কাটতে না কাটতেই গত সোমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে একটি চিঠি দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জ্জী।এতে তিনি চিঠিতে মমতা উল্লেখ করেন, রাজ্যের মানুষকে বঞ্চিত করে বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দেওয়া সম্ভব নয়।
তিস্তার পানির হিস্যা দেওয়া সম্ভব নয়: মমতা তিস্তার পানির হিস্যা দেওয়া সম্ভব নয়: মমতা
মমতা আরও অভিযোগ করেন, রাজ্যের সাথে কোনো আলোচনা না করেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশকে পানি দিতে চাইছে। এমনকি হুঁশিয়ারি দিয়ে মমতা বলেন, কেন্দ্র যদি একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে তাঁর প্রতিবাদে গোটা দেশজুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের চব্বিশ ঘন্টা যেতে না যেতেই মঙ্গলবার মমতার এই দাবিকে নাকচ করে দিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সূত্র বলছে, ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে চিঠি লিখেছিল কেন্দ্র। তাতে ১৯৯৬ সালে সই হওয়া ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির পুনর্নবীকরণ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা করার জন্য গঠিত কমিটিতে রাজ্যের তরফে মনোনীত প্রতিনিধি চাওয়া হয়েছিল।
ওই বছরেরই ২৫ আগস্ট রাজ্য সরকারের তরফ থেকে কমিটির জন্য পশ্চিমবঙ্গের সেচ ও জলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রধান প্রকৌশলী (নকশা ও গবেষণা)-কে মনোনীত করা হয়।
চলতি বছরের ৫ এপ্রিল রাজ্য সরকারের সেচ ও জলপথ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব চিঠি দিয়ে ফারাক্কা ব্যারাজের ভাটির অংশ থেকে পরবর্তী ৩০ বছরের জন্য তাদের মোট পানির চাহিদার বিষয়টি জানিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন…একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির প্রথম ধাপের ফল প্রকাশ
সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার মিথ্যা দাবি ছড়িয়েছে যে, ফারাক্কায় গঙ্গার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ১৯৯৬ সালের ভারত-বাংলাদেশ চুক্তির অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনাতে তাদের সাথে পরামর্শ করা হয়নি।
মঙ্গলবার দিনভর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এবং কেন্দ্রীয় প্রচারমাধ্যমে যখন মমতা ব্যানার্জ্জীর তিস্তা–গঙ্গা পানি চুক্তি সম্পর্কে রাজ্যকে অন্ধকারে রেখে দেওয়ার দাবিকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন দাবি করা হচ্ছে তখন ফের ময়দানে নামেন মমতা। নিজে প্রকাশ্যে না এলেও সচিবালয় নবান্ন থেকে সাংবাদিক সম্মেলন করেন তাঁর প্রধান উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতার হয়ে রাজ্যের এই জ্যেষ্ঠ আমলা দাবি করেন রাজ্য, দেশিক এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে লিখিত জানিয়েছেন।
আলাপন জানান, ২৪ জুনের আগেও ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর, ওই বছরেরই ২১ ফেব্রুয়ারি এবং তারও আগে ২০১৭ সালের ২৫ মে চিঠি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সবকটি চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছিলেন, ভারত-বাংলাদেশ জলবণ্টন বহু বছরের একটি বিষয়। যার উপরে নির্ভর করে কোটি কোটি মানুষের জল পাওয়ার ইস্যু। এর উপর নির্ভর গঙ্গার ভাঙনজনিত সমস্যাবলি। এছাড়াও এর উপর নির্ভর করে কৃষি, সেচ, পানীয় জল প্রভূত বিষয়।
কেন্দ্র যে বিষয়টিকে বাংলাকে অবগত রেখে করা হয়েছে বলে দাবি করছে সেটি হল, ২০২৩ সালের ২৪ জুলাই জলশক্তি মন্ত্রনালয়ে একটি ১২ সদস্যের টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে। তাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে রাখা হয়েছিল বলে আলাপন দাবি করেন।
এরপর গত ১৪ জুন সেই কমিটি কেন্দ্রীয় জল কমিশনকে তাদের রিপোর্ট দেয়। যা জলশক্তি মন্ত্রনালয়ে জমা পড়ে। তাঁদের দাবি, রাজ্য সরকারের চিফ ইঞ্জিনিয়ার মত দিয়েছেন। কিন্তু, এ ব্যাপারে দু–একটি ছোট ইনপুট ছাড়া আর কিছু চাওয়া হয়নি বলে দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রীর উপদেষ্টা।
আরও পড়ুন…ঋণের চাপে চিরকুট লিখে আ.লীগ সভাপতির আত্মহত্যা
অথচ মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক লেখা চিঠিতে যেভাবে উত্তর ও মধ্যবঙ্গ থেকে যে সমস্ত নদী বাংলাদেশে যায় এবং নদীর জলবণ্টন সংক্রান্ত গুচ্ছ সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে, তা এই রিপোর্টে বিন্দুবিসর্গও নেই বলে জানান আলাপন। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, জলশক্তি মন্ত্রনালয় এই কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কোনও চিঠি দেয়নি। কোনও যোগাযোগ করেনি। কোনও আলোচনাও করেনি।
আলাপন আরও জানান, মুখ্যমন্ত্রী দেশের প্রধানমন্ত্রীকে জলবণ্টন নিয়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন সেসবের কিছুই জলশক্তি মন্ত্রনালয়ের নজরে ছিল না। তারা সে সম্পর্কে রাজ্য সরকারকে কোনও কিছুই জানায়নি। শেষে তিনি বলেন, কেন্দ্র ও রাজ্যে নীতি নির্ধারক কোনও কমিটিতেই ভারত-বাংলাদেশ জলচুক্তি নিয়ে কোনও কথা বা আলোচনা হয়নি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা দেন, ২০২৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে। তার পুনর্নবীকরণের জন্য উভয় দেশের কারিগরি বিশেষজ্ঞরা আলোচনা শুরু করবেন। একইসঙ্গে তিনি এটাও জানান, তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্প সমীক্ষার ব্যাপারে ভারতের একটি কারিগরি দল খুব শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে।
বাংলাদেশের সাথে গঙ্গা কিংবা তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আপত্তি জানিয়ে আসছেন মমতা ব্যানার্জ্জী। তাঁর বক্তব্য, ‘ফারাক্কা চুক্তির কারণে আমরা ১৯৯৬ সাল থেকে কষ্ট ভোগ করছি।
বাংলার পানি বিক্রি দেওয়ার অর্থ হলো, আগামী দিনে গঙ্গার ভাঙন বাড়বে, মানুষের ঘরবাড়ি পানির তলায় তলিয়ে যাবে। ফারাক্কায় ড্রেজিং না করার ফলে কলকাতা বন্দরের নাব্যতা কমে গেছে, টান পড়েছে লাখ লাখ মানুষের জীবিকায়।
আরও পড়ুন…বিশ্বস্ত বন্ধু ভারত বাংলাদেশের:প্রধানমন্ত্রী
আবার তিস্তার পানি নিয়ে মমতার অভিমত, তিস্তায় পানি নেই। সেখান থেকে পানি দিলে উত্তরবঙ্গের একাংশের মানুষ আগামী দিনে খাবার পানি পাবে না, বিশাল অংশের মানুষের কৃষি কাজে সমস্যা হবে। অর্থাৎ রাজ্যের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করে কোনোভাবেই পানি দেওয়া সম্ভব নয়।
তিস্তা গঙ্গা পানি চুক্তি ইস্যুতে উত্তপ্ত হতে পারে ভারতের চলমান সংসদ অধিবেশন। তৃণমূল কংগ্রেস সূত্রগুলো বলছে, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের স্বার্থ উপেক্ষা করে তিস্তা–গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরে সামান্যতম পদক্ষেপ নিলে দেশজুড়ে গণ আন্দোলনের পাশাপাশি সংসদের ভেতরেও তীব্র প্রতিবাদের প্রস্তুতি নিয়েছে দলটি।