হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে যখন দরুদের ফজিলত পেশ করা হয়, তখন তিনি এ সুসংবাদ লাভ করে খুবই আনন্দিত হয়ে উঠেন। হযরত আবু তালহা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَاءَ ذَاتَ يَوْمٍ وَالسُّرُورُ فِي وَجْهِهِ ، فَقَالُوا : يَا رَسُولَ اللهِ إنَّا لَنَرَى السُّرُورَ فِي وَجْهِكَ؟ فَقَالَ : إِنَّهُ أَتَانِي الْمَلَكُ، فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ أَمَا يُرْضِيك أنَّهُ لاَ يُصَلِّي عَلَيْك مِنْ أُمَّتِكَ أَحَدٌ إلاَّ صَلَّيْت عَلَيْهِ عَشْرًا، وَلاَ يُسَلِّمُ عَلَيْك أَحَدٌ مِنْ أُمَّتِكَ إلاَّ سَلَّمْتُ عَلَيْهِ عَشْرًا؟ قَال : بَلَى.
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম (আমাদের মাঝে) আসলেন। তখন তার চেহারায় আনন্দের আভা বিরাজ করছিল। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার চেহারায় আনন্দ লক্ষ্য করছি।’ নবীজি বললেন, ‘আমার নিকট ফিরিশতা এসেছিল।’ বললো, ‘ইয়া মুহাম্মাদ! এ বিষয়টি কি আপনাকে আনন্দিত করবে না যে, (আপনার রব বলেছেন,) আপনার কোনো উম্মতী যদি আপনার প্রতি দরুদ পাঠ করে তাহলে আমি (আল্লাহ) তার প্রতি দশবার রহমত বর্ষণ করব? আর কোনো উম্মতী যদি আপনার প্রতি সালাম পেশ করে তাহলে আমি তার প্রতি দশবার সালাম-শান্তি বর্ষণ করব?’ নবীজি বললেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবাহ, হাদিস ৩২৪৪৮; সুনানে নাসাঈ, হাদিস ১২৮৩; সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদিস ১২০৬, ১২০৭)
প্রথম পর্ব: নবীর প্রতি দরুদ পড়লে নিজেরই লাভ
বর্ণনায় এমনও পাওয়া যায় যে, নবীজি একথা শুনে শুকরিয়া আদায় স্বরূপ সিজদায় লুটিয়ে পড়েছিলেন। (দ্রষ্টব্য : মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ১৬৬২, ১৬৬৩, ১৬৬৪)
বস্তুত হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ আনন্দ ছিল উম্মতের স্বার্থে। কেননা যার জন্য দরুদ পড়া হয় তার অপেক্ষা যিনি পড়েন তার নিজেরই বেশি ফায়দা। তাই এ সুসংবাদ ছিল মূলত উম্মতের জন্য সুসংবাদ। আর নবীজি যেহেতু উম্মতের কল্যাণে সদা বিভোর থাকতেন তাই এ সংবাদ শুনে তিনি এরকম আনন্দিত হয়ে পড়েছিলেন।
যতক্ষণ বান্দা দরুদ পড়তে থাকে ফেরেশতাগণ দোয়া করতে থাকেন। বান্দা যতক্ষণ দরুদে থাকে ফেরেশতাগণ ততক্ষণ তার জন্য রহমত, বরকত এবং মাগফিরাতের দোয়া করতে থাকেন। হাদিস শরিফে এসেছে-
مَنْ صَلَّى عَلَيَّ صَلَاةً لَمْ تَزَلِ الْمَلَائِكَةُ تُصَلِّي عَلَيْهِ مَا صَلَّى عَلَيَّ، فَلْيُقِلَّ عَبْدٌ مِنْ ذَلِكَ أَوْ لِيُكْثِرْ.
আমার উপর কেউ দরুদ পড়লে ফেরেশতাগণ তার জন্য দোয়া করতে থাকে যতক্ষণ সে আমার প্রতি দরুদে রত থাকে। এখন বান্দার ইচ্ছা- বেশি বেশি দরুদ পড়বে, না কম। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ১৫৬৮০; কিতাবুয যুহদ, ইবনুল মুবারক, হাদিস ১০২৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস ৯০৭)
যার ওসিলায় দোয়া কবুল হয়
দরুদের আমল আল্লাহ তায়ালার নিকট অত্যন্ত প্রিয় আমল। দরুদের ওসিলায় আল্লাহ তায়ালা বান্দার দুআ কবুল করেন। হজরত উমর (রা.) বলেন-
إِنَّ الدُّعَاءَ مَوْقُوفٌ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ لاَ يَصْعَدُ مِنْهُ شَيْءٌ، حَتَّى تُصَلِّيَ عَلَى نَبِيِّكَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
আসমান-জমিনের মাঝে দোয়া ঝুলন্ত থাকে। তুমি তোমার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দরুদ পেশ করা পর্যন্ত তা উপরে ওঠে না। (জামে তিরমিযী, হাদিস ৪৮৬)
তাই দোয়া করার একটি আদব হচ্ছে, দোয়ার সূচনা-সমাপ্তি দরুদের মাধ্যমে করা।
নবীজির নৈকট্য ও শাফাআত লাভের মাধ্যম
দরুদের মাধ্যমে যেভাবে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ হয় তেমনি এর মাধ্যমে অর্জিত হয় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নৈকট্য। নবীজি বলেন-
أَوْلَى النَّاسِ بِي يَوْمَ القِيَامَةِ أَكْثَرُهُمْ عَلَيَّ صَلاَةً.
কেয়ামতের দিন আমার নৈকট্য লাভ করবে ওই ব্যক্তি, যে আমার প্রতি বেশি বেশি দরুদ পাঠ করে। (জামে তিরমিযী, হাদিস ৪৮৪)
নবীজির প্রতি মহব্বত ও ভালোবাসা প্রকাশের একটা মাধ্যম হল অধিক পরিমাণে দরূদ পেশ করা। অতএব যিনি নবীজিকে মহব্বত করবেন রহমতের নবী তাকে স্নেহের সঙ্গে গ্রহণ করে নেবেন তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে কেয়ামতের বিভীষিকাময় মুহূর্তে নবীজি তাকে ভুলে বসবেন- তা কি ভাবা যায়! এ বিষয়টিই উল্লেখিত হয়েছে আলোচ্য হাদিসে।
কেয়ামতের দিন নবীজির নৈকট্য লাভ করার একটি অর্থ হল, কেয়ামতের দিন সে নবীজির শাফাআত লাভে ধন্য হবে, ইনশাআল্লাহ। এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
من صلى عَليّ حِين يصبح عشرا وَحين يُمْسِي عشرا أَدْرَكته شَفَاعَتِي يَوْم الْقِيَامَة.
قال الحافظ المنذري : رَوَاهُ الطَّبَرَانِيّ بِإِسْنَادَيْنِ أَحدهمَا جيد.
যে আমার প্রতি সকালে দশবার আর সন্ধ্যায় দশবার দরূদ পড়বে কিয়ামতের দিন সে আমার শাফাআত লাভ করবে। (আততারগীব ওয়াততারহীব, মুনযিরী, হাদিস ৯৮৭)
যে আমল পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিয়োজিত রয়েছে ফিরিশতাদের বিশেষ জামাত
আমরা যখন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে দরুদ ও সালাম পেশ করি তখন তা পৌঁছে যায় প্রিয় নবীজির রওজা মুবারকে সোনার মদিনায়। যে যেখানে যত দূরেই অবস্থান করুক না কেন। বান্দার দরুদের হাদিয়া পৌঁছে দেওয়ার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে নিযুক্ত রয়েছে ফেরেশতাদের বিশেষ জামাত। নবীজি বলেন-
إِنَّ لِلهِ فِي الْأَرْضِ مَلَائِكَةً سَيَّاحِينَ، يُبَلِّغُونِي مِنْ أُمَّتِي السَّلَامَ.
আল্লাহর পক্ষ থেকে যমিনে বিচরণকারী ফেরেশতারা নিযুক্ত রয়েছেন। তারা আমার উম্মতের পক্ষ থেকে আমার নিকট সালাম পৌঁছায়। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৩৬৬৬, ৪২১০, ৪৩২০; সুনানে নাসাঈ, হাদিস ১২৮২; আমালুল ইয়াওমি ওয়াললাইলাহ, হাদিস ৬৬, সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদিস ১২০৬, ৯৮১১, ১১৯৩২)
বর্ণনায় এও পাওয়া যায় যে, দায়িত্বশীল ফেরেশতা দরুদ পেশকারীর নাম ও পিতার নামসহ দরুদের হাদিয়া নবীজির খেদমতে পেশ করেন। কিয়ামত পর্যন্ত সবার দরুদ নবীজির খেদমতে এভাবে পেশ করা হতে থাকবে। (দ্রষ্টব্য : মুসনাদে বাযযার, হাদিস ১৪২৫)
তাই উম্মতের কর্তব্য হচ্ছে দরুদের হাদিয়ার মাধ্যমে নবীজির নিকট নিজেকে বেশি বেশি পেশ করা। এই মেজাজ ও উপলব্ধি নিয়ে যদি দরুদ পড়া হয় তাহলে নবীজির প্রতি ঈমানি মহব্বতও বৃদ্ধি পেতে থাকবে, ইনশাআল্লাহ।
যে আমলে অবহেলার ব্যাপারে এসেছে কঠোর হুঁশিয়ারি
পূর্বেই আমরা যেমনটি উল্লেখ করে এসেছি, আমাদের উপর নবীজির একটি বড় হক হচ্ছে তার শানে দরূদ ও সালাম নিবেদন করা। কখনো কখনো এ হক আরো জোরালো হয়। বিশেষ করে যখন নবীজির নাম উচ্চারিত হয় তখন তার প্রতি দরূদ পড়া খুবই জরুরি। নবীজি বলেন-
رَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ، وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ دَخَلَ عَلَيْهِ رَمَضَانُ فَانْسَلَخَ قَبْلَ أَنْ يُغْفَرَ لَهُ، وَرَغِمَ أَنْفُ رَجُلٍ أَدْرَكَ عِنْدَهُ أَبَوَاهُ الْكِبَرَ فَلَمْ يُدْخِلَاهُ الْجَنَّةَ.
ওই ব্যক্তির জন্য ধিক, যার সামনে আমার নাম উচ্চারিত হয় আর সে আমার প্রতি দরূদ পড়ে না। ওই ব্যক্তির জন্য ধিক, যে রমাজান পেল অতঃপর তার গুনাহ মাফ হওয়ার পূর্বেই তা গত হয়ে গেল। ওই ব্যক্তির জন্য ধিক, যে পিতা-মাতাকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল অথচ তাদের (সেবা ও দুআ নেওয়ার) মাধ্যমে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস ৭৪৫১; জামে তিরমিযী, হাদিস ৩৫৪৫)
অতএব নবীজির নাম শুনলে দরূদ পড়ার উপর গুরুত্বারোপ করা খুবই জরুরি। এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
البَخِيلُ الَّذِي مَنْ ذُكِرْتُ عِنْدَهُ فَلَمْ يُصَلِّ عَلَيَّ.
কৃপণ ওই ব্যক্তি, যার নিকট আমার নাম আলোচিত হল অথচ সে আমার প্রতি দরুদ পড়ল না। (জামে তিরমিযী, হাদিস ৩৫৪৬; সুনানে কুবরা, নাসায়ী, হাদিস ৯৮০২)
বস্তুত দরুদ শরীফের আমল এমন একটি মহিমান্বিত আমল, যাতে নিহিত রয়েছে প্রভূত কল্যাণ। এতে আল্লাহ তাআলার খাছ রহমত লাভ হয়। আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়। নিজের দ্বীন ঈমানের তারাক্কী হয়। আত্মিক উৎকর্ষ সাধিত হয়। পেরেশানি লাঘব হয়। মুশকিলাত আসান হয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রূহানী ফায়য হাছিল হয়। নবীজির প্রতি ঈমানী মহব্বত বৃদ্ধি পেতে থাকে। নবীজির শাফাআত লাভের আশা করা যায়। সর্বোপরি পরকালীন সফলতার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে দরূদ শরীফের।
ইবাংলা /এইচ/১৬ নভেম্বর, ২০২১