ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায় যে নদী

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি :

কখনও লাল-নীল, কখনও খয়েরি, কালো।  আবার কখনও দুধের মতো সাদা।  একেক সময় একেক রঙ ধারণ করে নদীর পানি।  শুনতে অবাক লাগলেও এমনই এক নদী আছে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায়।  নদীটির নাম বানার নদী।

জানা যায়, এর কারণ নদীর আশপাশে গড়ে ওঠা মিল-কারখানা।  দূষিত পানির কারণে নষ্ট হয়েছে নদীর জীববৈচিত্র্যও।  প্রায় দুই যুগ ধরে নদীর মাছ শিকার করে, বাজারে বিক্রি করে সংসার চলে কালু মিয়ার।  ৩-৪ বছর হলো কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য মিশ্রিত পানি নদীতে প্রবাহিত হওয়ায় আর আগের মতো মাছ ধরা পড়ে না জালে।

কালু মিয়া এখন আগের পেশা ছেড়ে, দিনমজুরের কাজ করেন।  তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আশপাশের কারখানাগুলোর বিষাক্ত কেমিক্যালে গতবার গাঙ্গের (নদীর) সব মাছ মইরা ভাইস্যা উঠছিল।  এইবারও গাঙ্গের সব মাছ মইরা সাবাড় অইব।’

ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রতিদিন বিভিন্ন কারখানার লাল, নীল, গোলাপি, কালো ও গাঢ় সাদা রঙের বিষাক্ত বর্জ্যমিশ্রিত পানি নামছে বানার, খিরু ও সুতিয়া নদীতে। এখানকার শিল্প-কারখানাগুলোতে ইটিপি ব্যবহার না করার কারণে গত বছরের ন্যায় এবছরও বিষাক্ত বর্জ্যে নদীগুলোর মাছ মরে সাবাড় হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

আমিরাবাড়ী ইউনিয়নের গুজিয়াম এলাকায় ড্রেসডেন টেক্সটাইল লিমিটেডসহ ত্রিশালে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি শিল্প-কারখানা। ড্রেসডেন টেক্সটাইলের লাল, নীল, গোলাপি, কালো ও অন্যান্য কারখানার গাঢ় সাদাসহ বিভিন্ন রঙের বিষাক্ত বর্জ্যমিশ্রিত পানি প্রতিদিন চৌহার খাল হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে সুতিয়া, বানার ও খিরু নদীতে।

শিল্প-কারখানাগুলোতে ইটিপি ব্যবহার না করার কারণে বিষাক্ত বর্জ্যে গত বছর ওই নদীগুলোর মাছ মরে সাবাড় হয়েছিল। এ নিয়ে ওই সময় সমকালের প্রথম পাতায় প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছিল। খাল-বিল ও নদীর মাছসহ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়লেও টনক নড়েনি কারখানা মালিকদের।

আরও পড়ুন : গাছের মগডালে মাদরাসা ছাত্রের লাশ

স্থানীয়রা জানান, বছরজুড়ে কারখানাগুলো থেকে বিষাক্ত বর্জ্যমিশ্রিত পানি নদীতে নামলেও বর্ষাকালে বোঝার কোনো উপায় থাকে না। শীতকালে নদীর পানি কমে যাওয়ায়, বিভিন্ন কারখানার লাল, নীল, সবুজ, কালো ও গাঢ় সাদা রঙের বিষাক্ত বর্জ্যমিশ্রিত পানি সবারই চোখে পড়ে।

তারা জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর বিষাক্ত বর্জ্যের মাত্রা আরও বেড়েছে। এতে গত বছরের ন্যায় এ বছরও সুতিয়া, বানার ও খিরু নদীর মাছ মরে সাবাড় হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এছাড়া কৃষিজমি ঘেঁষা চৌহার খালসহ নদীগুলোর পাড়ে শীত-মৌসুমের ফসল ফলানো থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, আমিরাবাড়ী ইউনিয়নের গুজিয়াম এলাকায় বিষাক্ত বর্জ্যমিশ্রিত পানি আরসিসি পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতিদিনই চৌহার খাল হয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বানার, খিরু ও সুতিয়া নদীতে। এছাড়া আরও কয়েকটি শিল্প-কারখানার বর্জ্যমিশ্রিত গাঢ় সাদাসহ বিভিন্ন রঙের পানিও নামছে নদীগুলোতে।

নামাপাড়া গ্রামের মফিজুল ইসলাম বলেন, এক দশক আগেও বর্ষাকালে বানার, সুতিয়াসহ আশপাশের খাল বিলগুলোতে কমপক্ষে ৩০ প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত।  এখন নদীতে পুঁটি, চিংড়ি, টাকিসহ মাত্র কয়েক জাতের মাছ পাওয়া যায়। বর্ষা শেষে শীতকালে নদীতে ‘বাওয়া’ নামত, দল বেঁধে অনেক লোক একসঙ্গে মাছ ধরত।  এখন এই নদীতে বাওয়ার ওই দৃশ্য আর চোখে পড়ে না।  কারখানাগুলোর বিষাক্ত বর্জ্যে বিলুপ্ত হয়েছে অত্যন্ত সুস্বাদু প্রজাতির মাছগুলোও।

নারায়ণপুর গ্রামের সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘বানার নদীতে লাল, নীল, গোলাপি ও কালো রঙের বিষাক্ত বর্জ্যমিশ্রিত পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে মানুষের গোসল করা, গরু ধোয়া ও হাঁসপালন বন্ধ হয়ে গেছে।  হাঁস ওই বিষাক্ত পানিতে নামলেই মারা যায়।  নদীপাড়ের জমিতে কোনো ফসলের চাষও করতে পারি না।’

পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মোক্ষপুর গ্রামের গিয়াস উদ্দিন ও সিরাজুল ইসলামসহ অন্যরা জানান, শিল্পকারখানার কারণে খাল, বিল, নদীনালাগুলোর মরণদশা। কারখানার মালিকরা অপরিশোধিত বর্জ্য খাল, বিল, নদীনালায় ফেলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের বারোটা বাজাচ্ছেন।

সচেতন মহলের দাবি, প্রতিটা শিল্পকারখানায় বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন ও তা নিয়মিত ব্যবহার দরকার। ওই কারখানাগুলোর সকল বর্জ্য শোধন করে তবেই তা বাইরে অর্থাৎ খাল-নদী বা অন্য কোনো স্থানে ফেলার ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। পরিবেশ অধিদফতরের নজরদারি বা তৎপরতা থাকলে, বর্জ্যের দ্বারা পরিবেশ দূষণ কমে যাবে।

উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘পরিশোধন না করে কারখানার সিরামিক, কাচ ও ধাতব শিল্পবর্জ্য খাল-নদীতে ফেললে তা মাছের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর।  মাছের বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন দরকার ৬.৫ থেকে ৭ মিলিগ্রাম।

অক্সিজেনের পরিমাণ কমে এবং আয়রন ও নাইট্রেটের পরিমাণ বেড়ে গেলে মাছ মারা যায়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে প্রজননেও সংকট দেখা দেয়। এছাড়া মাছের দেহে জিংক, কপার, ক্রোমিয়াম, নিকেল ইত্যাদি ভারী ধাতুর দূষণ থাকলে ওইসব মাছ খাওয়া মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।

বিভিন্ন রঙের বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য মিশ্রিত পানি নদীতে ফেলার বিষয়ে জানতে ড্রেসডেন টেক্সটাইল লিমিটেডের গ্রুপ এজিএম নূরা আলম খোকনের সঙ্গে কথা বললে, তিনি জানান, ইটিপি স্থাপনের কাজ চলমান। দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করে বর্জ্য শোধনে তা ব্যবহার শুরু করা হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে আসছে।  পরিবেশ অধিদফতরকে সঙ্গে নিয়ে এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

পরিবেশ অধিদফতরের ময়মনসিংহ বিভাগীয় পরিচালক ফরিদ আহমদ বলেন, ‘ইটিপি চালু রাখার জন্য কারখানাগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কেউ বন্ধ রাখলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ইবাংলা/এএমখান/২৯ নভেম্বর, ২০২১

Contact Us