কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) অধিকতর উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের স্বাক্ষর করার কথা থাকলেও আইন না মেনে তাতে স্বাক্ষর করেছেন রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্রের অভিযোগ উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতির জন্যই রেজিস্ট্রার ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেআইনীভাবে নিজেই এ চুক্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে স্বাক্ষর করেন। ড. মো. আবু তাহেরের বিপক্ষে ইতিপূর্বেও সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
গত বছরের ১১ মার্চ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেডকোয়ার্টারে সেনাবাহিনীর পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আলী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে স্বাক্ষর করেন রেজিস্ট্রার ড. মো. আবু তাহের। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামানের।
কিন্তু দুর্নীতি করার সুবিধার্থে কোষাধ্যক্ষকে এই প্রকল্পের বাইরে রাখার অংশ হিসেবে রেজিস্ট্রার নিজেই আইনবহির্ভূতভাবে এ স্বাক্ষর করেন বলে অভিযোগ অনেকের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তা বলেন, প্রায় এক হাজার সাতশত কোটি টাকার এই একটি প্রকল্পকে ঘিরে উপাচার্য ড. এমরান কবির চৌধুরী ও রেজিস্ট্রার ড. মো. আবু তাহের দুর্নীতির সুবিধার্থে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কাজে নিজের গ্রুপের ঘনিষ্ঠ লোকজনকে যুক্ত করেছেন। এর অংশ হিসেবেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে বেআইনীভাবে স্বাক্ষর করেন রেজিস্ট্রার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে আমি উপাচার্য মহোদয়কে অবহিত করেছি তখন। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পরে স্যার আমাকে আর কিছুই জানায়নি। তখন আমাকে শুধু এটুকুই জানানো হয়েছে যে, সেনাবাহিনীর সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। কিন্তু কাকে দিয়ে স্বাক্ষর করা হবে আমাকে জানানো হয়নি।
অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে অর্থ সংশ্লিষ্ট সকল চুক্তি স্বাক্ষর করবেন ট্রেজারার। এর ব্যত্যয় কেনো হলো এটা একটা রহস্য। এসবের পিছনে কার কি উদ্দেশ্য ছিল তা আমি বলছি না। তবে এটা সুনির্দিষ্টভাবে আইন পরিপন্থী কাজ। এ বিষয়ে রেজিস্ট্রার ড. মো. আবু তাহের বলেন, ভিসি স্যারের আদেশক্রমেই আমি স্বাক্ষর করেছি। এটা কাজের চুক্তি। অর্থনৈতিক চুক্তি না।
রেজিস্ট্রারের এ বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আসাদুজ্জামান বলেন, এ কাজটা তো হবে অর্থের মাধ্যমে। যে কাজে টাকার সম্পৃক্ততা থাকবে সেটাই তো আর্থিক চুক্তি। তাহলে তারা কীভাবে বলে এটা আর্থিক চুক্তি না সেটা বুঝি না। এটা অযৌক্তিক কথাবার্তা।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী বলেন, আইন মেনেই স্বাক্ষর করা হয়েছে। রেজিস্ট্রারের করার কথা তিনিই স্বাক্ষর করেছেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৬ এর ১২ (২) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ট্রেজারার বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অর্থ সংক্রান্ত সকল চুক্তিতে স্বাক্ষর করিবেন। কিন্তু এ চুক্তিতে আইন মানা হয়নি বলে দাবি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের অনেকের।
এর আগে গত বছর অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক কামাল উদ্দিন ভূঁইয়াকে অনৈতিকভাবে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে রেজিস্ট্রারের পক্ষের একজন শিক্ষককে বসানোর চেষ্টা করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের চাপে সেটি সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে কামাল উদ্দিন ভূঁইয়াই এ দায়িত্বে ফিরে আসেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, রেজিস্ট্রার তার কাছের একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. শামিমুল ইসলামকে অর্থ ও হিসাব দপ্তরের পরিচালক বানাতে গিয়েই অনৈতিকভাবে কোনো দোষ ছাড়াই কামাল উদ্দিনকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন।
এর আগে অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের শুরুতেই পরিকল্পনা দপ্তরের দায়িত্বে থাকা উপপরিচালক মো. দেলোয়ার হোসেনকে সরিয়ে রেজিস্ট্রারের আস্থাভাজন মো. শাহাবুদ্দিনকে সে দায়িত্বে বসানো হয়। বর্তমানে মো. শাহাবুদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পর্যায়ের উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক। অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি নির্বিঘ্ন করতেই রেজিস্ট্রার নিজের লোক দিয়ে এ দল তৈরি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে উপাচার্য ড. এমরান কবির চৌধুরীর যোগসাজশে অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, টেন্ডারে ভাগ বাটোয়ারায় লিপ্ত হয়ে পড়ার অভিযোগ করেন অনেকে। এর আগেও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।
২০১১ সালে ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে সোলার প্যানেল বসানো হয়। বর্তমান রেজিস্ট্রার ড. তাহের সে প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। ওই বছরই ওই সোলার প্যানেল অকেজো হয়ে পড়ে। সেটা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কাজে আসেনি। ড. তাহের বাংলাদেশ অল্টারনেটিভ এনার্জি সিস্টেম লিমিটেড নামে নিম্নমানের একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে এ প্রকল্পের সিংহভাগ টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ উঠে।
২০১৮ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে আবেদনের যোগ্যতা না থাকলেও শারমিন রেজোয়ানা নামে একজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। টাকার বিনিময়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে ড. আবু তাহের এ নিয়োগ দেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক এ বিষয়টি জানান।
এছাড়াও, ২০১৬-২০১৭ শিক্ষাবর্ষে বর্তমান রেজিস্ট্রার ড. আবু তাহের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ইউনিট কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। সে বছর এ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয় বলে অভিযোগ উঠেছিল।
ইবাংলা/ টিআর/ ২১ জানুয়ারি