নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ’র ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা দিয়ে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় জুডিসিয়াল তদন্ত শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার (৬ সেপ্টম্বর) জুডিসিয়াল তদন্তের কর্মকর্তা নড়াইল চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতের চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট শেখ মোহাঃ আমীনুল ইসলাম ঘটনাস্থল মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ পরিদর্শন করেছেন।
তাঁর সাথে ছিলেন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ মোর্শেদুল আলম। তদন্ত কর্মকর্তা কলেজ পরিদর্শন শেষে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের সাথে তদন্তের ব্যাপারে কথা বলেন। এ সময় কলেজ’র জিবি’র সদস্য ও বিছালী ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান এসএম আনিসুল ইসলাম,একাডেমিক কাউন্সিলের আহবায়ক সহকারি অধ্যাপক শেখ আকিদুল ইসলাম সহ শিক্ষক-কর্মচারীবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
আরও পড়ুন…নোয়াখালী আব্দুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজে তালা,কর্মচারীর অবরুদ্ধ
ছাত্র রাহুলের একটি ফেসবুক পোষ্টকে কেন্দ্র করে গত ১৮ জুন কলেজে আন্দোলন চলাকালে একটি কুচক্রী মহলের ইশারায় প্রশাসনের সামনেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গালায় জুতার মালা দেয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৭ জুলাই মহামান্য উচ্চ আদালত বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের জবানবন্দি গ্রহনের জন্য নোটিশ করা হয়েছে। তিনি তদন্ত কর্মকর্তার নিকট আগামী ৮ সেপ্টম্বর জবানবন্দি প্রদান করবেন বলে জানান।
ইতোমধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর পৃথক দু’টি তদন্ত সম্পন্ন করেছে। তদন্ত শেষে কলেজের জিবি এবং কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আকতার হোসেনকে কারণ দশার্নোর নোটিশ দিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। একই ভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের তদন্তে কলেজে ১৮ জুনের ঘটনায় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক আকতার হোসেন’র ভূমিকা রহস্যজনক ও প্রশ্নবিদ্ধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৮ জুনের ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা ৪টি বিভাগীয় মামলার তদন্ত চলছে। কলেজে হামলা ও শিক্ষক হেনস্তার ঘটনার ৯ দিন পর গত ২৭ জুন দুপুরে নড়াইল সদর থানায় পৃথক আরেকটি মামলা করেন পুলিশের উপ-পরিদর্শক ও মির্জাপুর ফাঁড়ির ইনচার্জ শেখ মোরছালিন। এ মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ১৭০ থেকে ১৮০ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় এ পর্যন্ত ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর বাইরে মিডিয়া কর্মীদের একাধিক তদন্ত দলের তদন্ত চলছে।
আরও পড়ুন…জমি সংক্রান্ত বিরোধে প্রতিপক্ষের হামলায় আহত ৫
একের পর এক তদন্ত চলছে। কিন্তু ভালো নেই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। তিনি প্রচ্ছন্ন হুমকির মুখে আছেন। ষড়যন্ত্রকারিরা থেমে নেই। আবারও তাকে বেকায়দায় ফেলতে পারেন বলে তিনি আশংকা করছেন। কলেজে যাতায়াত সহ বেশিরভাগ সময় তিনি পুলিশ পাহারায় থাকেন। তারপরও তিনি নিজেকে নিরাপদ মনে করছেন না। কলেজেই তিনি নিজেকে বেশি অনিরাপদ মনে করছেন বলে জানান। গত ৩ আগষ্ট তিনি কলেজে ফেরেন। এরপর থেকে নিয়মিত কলেজ করছেন। গত ৬ আগষ্ট কিছু শিক্ষার্থী অধ্যক্ষ’র কার্যালয়ে গিয়ে পুলিশের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার হওয়া ৪ জন শিক্ষার্থীকে জামিনে মুক্ত করে আনার জন্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে চাপ সৃষ্টি করে।
বিষয়টি জানতে পেরে দ্বায়িত্বরত পুলিশ এগিয়ে গেলে ওই শিক্ষার্থীরা সটকে পড়ে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে কলেজের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করার জন্য কয়েকজন শিক্ষক ওই চক্রের শত্রæতে পরিণত হয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরোধি চক্ররা কলেজে এবং কলেজের বাইরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে সমর্থনকারি শিক্ষকদের অসম্মান ও হয়রানী করার জন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। নানা ভাবে অঙ্গভঙ্গি করে হুমকি দিচ্ছে। প্রকাশ্যে দিবালোকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সহ ৩ জন শিক্ষকের মোটরসাইকেল ভেঙ্গে পুড়িয়ে দেয়া হয়।
মোটরসাইকেল না থাকায় ভারপ্রাপ্ত খুবই কষ্টে যাতায়াত সহ দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। বাস বা অন্য কোন যানবাহনের পথ না হওয়ায় কলেজে যাতায়াত করতে খুব কষ্ট হচ্ছে বলে জানান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। তিনি ভ্যান, ইজিবাইক ও অন্যের মোটরসাইকেলে যাতায়াত করছেন। অনেক সময় হেঁটে যাতায়াত করতে হচ্ছে। মাসিক যে বেতন পান,তা দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়া সহ কোন রকম সংসার চলে। পুনরায় একটি মোটরসাইকেল কেনার মত কোন সংগতি নেই। এহেন পরিস্থিতিতে তিনি মানসিক ভাবে ভেংগে পড়েছেন। অরপদিকে গত ১৮ জুন তাকে লাঞ্ছিতের ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িতরা নানাভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে।
তারা কুট কৌশল করছে যে কোন উপায়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে হয়রানি ও নাজেহাল করার জন্য। এমনকি কলেজের শিক্ষার্থীদের উসকে দিয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস বলেন,তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে লাঞ্ছিত হয়েছেন। ওই চক্র সক্রিয় থাকায় তিনি আতংকে আছেন।
আরও পড়ুন…২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক গেমসে পাবলিক সিগন্যাল তৈরির চুক্তি করল সিএমজি
গত ৩ আগষ্ট ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস কলেজে ফিরলে তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। নড়াইল-১ আসনের সাংসদ বিএম কবিরুল হক মুক্তি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর আব্দুস সালাম হাওলাদার, রেজিস্ট্রার মোল্যা মাহফুজ আল হুসাইন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ মণিটরিং এন্ড ইভালুয়েশন বিভাগের ডাইরেক্টর এএসএম রফিকুল আকবর, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোসভ।
মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ’র জিবি’র সভাপতি এ্যাডভোকেট অচিন কুমার চক্রবর্তী,জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও জেলা রেড ক্রিসেন্ট’র সম্পাদক কাজী ইসমাইল হোসেন লিটন, বীরমুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট এসএ মতিন, সমাজসেবক কল্যাণ মুখার্জী সহ অনেকে তাকে মানসিক ভাবে শক্তি সাহস দিয়ে সততার সাথে দ্বায়িত্ব পালনের জন্য উৎসাহ দেন। তাঁকে কাছে পেয়ে শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। সকলের আশ্বাসে সেই থেকে তিনি নিয়মিত কলেজ করছেন।
অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) স্বপন কুমার বিশ্বাস প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “ গত ১৮ জুন হতে পরিবার পরিজন ছেড়ে পালিয়ে আতœগোপনে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। কতিপয় স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ষড়যন্ত্রমুলক ভাবে তাকে ফাঁসিয়ে হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। তাকে চরম অপদস্থ করার পর তার মোটর সাইকেল সহ ৩টি মোটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনার পর কলেজ বন্ধ ঘোষনা করা হয়।
গত ২৪ জুলাই কলেজ খোলা হয়েছে। দীর্ঘ ১মাস ৫দিন পর কলেজ খোলা হয়। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ জোবায়ের হোসেন চৌধুরী উপস্থিত থেকে কলেজ খোলার ব্যবস্থা করেন। তবে অধিকাংশ শিক্ষকের চোখেমুখে আতংকের ছাপ রয়ে গেছে। মোটরসাইকেল নিয়ে আসতেও ভয় পাচ্ছেন শিক্ষকরা।
আরও পড়ুন…এশিযা কাপের দৌড়ে এগিয়ে যারা
এদিকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে বাদ দিয়ে গত ১৩ জুলাই জিবি’র সভা করা হয়েছে। ওই সভায় স্থানীয় শিক্ষকদের ধন্যবাদ জানিয়ে এই মর্মে রেজুলেশন করা হয়েছে যে, স্থানীয় শিক্ষকরা গত ১৮ জুন কলেজে সংঘঠিত ছাত্র ও সাধারণ জনগনের আন্দোলন থামাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। কেউ কেউ মনে করছেন এমন রেজুলেশন করে শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন করা হয়েছে। কারণ স্থানীয় শিক্ষক ছাড়া বহিরাগত শিক্ষকরা এ কলেজের জিবি’তে কখনও শিক্ষক প্রতিনিধি হতে পারেন না। গত ১৮ জুনের বিক্ষোভের সময় যে ৩জন শিক্ষকের মোটর সাইকেল ভাংচুর ও পোড়ানো হয়,তারা সকলেই বহিরাগত শিক্ষক।
প্রসঙ্গত: মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ’র প্রথম বর্ষের ছাত্র রাহুল দেব রায় গত ১৭ জুন ফেসবুকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বহিষ্কৃত মুখপাত্র নূপুর শর্মার একটি ছবি দিয়ে তার সমর্থনে লেখে “ প্রণাম নিও বস নুপুর শর্মা, জয় শ্রী রাম”। পরদিন ১৮ জুন রাহুল দেব রায় কলেজে গেলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে উঠে। তাৎক্ষণিক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস তাকে মির্জাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মুরসালিনের নিকট হস্তান্তর করেন। তিনি তাকে নিয়ে যেতে গেলে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা বাঁধা দেয়।
আরও পড়ুন…প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা এবং গার্ড অব অনার
এরপর সেখানে ছুটে আসেন সদর থানার ওসি শওকত কবীর। তিনি আপ্রান চেষ্টা করেন ছাত্র রাহুলকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্রকারিদের জন্য ব্যর্থ হন। এরই মধ্যে দুপুরের দিকে কে বা কারা গুজব ছড়িয়ে দেয় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ওই ছাত্রকে সমর্থন দিয়েছেন,তার কোন বিচার করতে চাননি। গুজবে এলাকার সাধারণ মানুষ কলেজে এসে বিক্ষোভ করে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও পুলিশ সুপার প্রবীর কুমার রায় ঘটনাস্থলে থাকা সত্বেও শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরিয়ে কলেজ হতে বের করা হয়। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সহ শিক্ষকদের ৩টি মোটরসাইকেল ভাংচুর করে পুড়িয়ে দেয়া হয়। মোবাইল ফোনে ধারণ করা এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দেশজুড়ে তৈরি হয় তীব্র ক্ষোভ।
এদিকে গত ২৪ আগষ্ট নড়াইলে যোগদান করেছেন পুলিশ সুপার সাদিরা খাতুন। তিনি ২৮ আগষ্ট মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজ পরিদর্শন করেছেন। পুলিশ সুপার সাদিরা খাতুন বলেন, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস ও তার পরিবারের নিরাপত্তার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহন সহ তাঁকে লাঞ্ছিতের সাথে জড়িতদের কঠোর আইনের আওতায় আনা হবে।
ইবাংলা/জেএন/০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.