দেশের বাইরে সম্পদ বা বাড়ি করা বাংলাদেশিদের ব্যাপারে দেশের উচ্চ আদালত বার বার দুদককে তদন্তের নির্দেশ দিয়ে যাচেছন৷ কিন্তু দুদকের নিজের উদ্যোগে তদন্ত শুরুর নজির খুব কম৷ আর তদন্তে শেষ পর্যন্ত কী হয় তাও জানা যায় না৷
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের(টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘হাইকোর্টকে যে এই বার বার নির্দেশ দিতে হয় তাতে প্রমাণ হয় যে যাদের এই কাজ তারা ঠিকমত তাদের দায়িত্ব পালন করছে না৷তবে দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম বলেন, ‘‘আমাদের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে আইনি প্রক্রিয়ায় এগোতে হয়৷ এটা সময়সাপেক্ষ৷’’
দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির সম্পদ
সর্বশেষ দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির সম্পদ কেনার অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দুদকসহ চার সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট৷ দুদক ছাড়াও সিআইডি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) এই নির্দেশ দেয়া হয়৷
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রোববার এই আদেশ দেন৷ ৩০ দিনের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত৷ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য ধরে একটি রিটের শুনানিতে এই নির্দেশ দেয়া হয়৷
আরও পড়ুন…নোয়াখালীতে সরকারি খাস জায়গা থেকে অবৈধ ৩০ স্থাপনা উচ্ছেদ
গত ১১ জানুয়ারি একটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয় যে দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির এক হাজারের মতো প্রপার্টি আছে৷ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানিয়েছে, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে প্রপার্টি কিনেছেন ওই ৪৫৯ বাংলাদেশি৷ ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি সম্পত্তি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে৷ কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ইউএস ডলার৷
ওয়াসার এমডির ১৪ বাড়ি
এর কয়েকদিন আগে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক(এমডি) তাকসিম এ খানের যুক্তরাষ্ট্রে ১৪টি বাড়ি থাকার খবর প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমে৷ এরপর ৯ জানুয়ারি হাইকোর্টের একই বেঞ্চ ওই বাড়ির বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয় দুদককে৷ তবে ওয়াসার এমডি অবশ্য যুক্তরষ্ট্রে তার স্ত্রীর নামে একটি বাড়ি থাকার কথা স্বীকার করেন৷ আর সব সম্পদের কথা অস্বীকার করেছেন৷
এর আগে যারা দেশের বাইরে অর্থ পাচার করে সেখানে সম্পদ গড়ে তুলেছেন তাদের একটি তালিকা দুদকের কাছে চায় হাইকোর্ট৷ গত বছরের ২৭ জানুয়ারি এরকম মোট ৬৭ জনের তালিকা হাইকোর্টে জমা দেয় দুদক তবে ওই তালিকায় বিস্তারিত তথ্য না থাকায় আদালত তখন অসন্তোষ প্রকাশ করেন৷ এর আগেও আদালতের নির্দেশে দুদক ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর ২৯ ব্যক্তি ও ১৪ প্রতিষ্ঠানের তালিকা দেয়৷
লন্ডনের অভিজাত এলাকায়ও বাংলাদেশিরা
হাইকোর্টের সর্বশেষ নির্দেশের পরও বিদেশে বাংলাদেশিদের অঢেল সম্পদ থাকার তথ্য প্রকাশ হয়েছে। ১৫ জানুয়ারি একটি বাংলা দৈনিক খবর দিয়েছে লন্ডনের অভিজাত এলাকায় বাড়ির মালিক বিদেশিদের মধ্যে বাংলাদেশিরাও আছেন। খবরে বলা হয়, প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনে প্রপার্টি ক্রেতাদের মধ্যে বিদেশি এখন ৪০ শতাংশ।
আরও পড়ুন…ইসলামের অনুসারীদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে কি ধর্ম (ইসলাম) প্রযোজ্য
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনীদের বিনিয়োগ কোটায় অভিবাসনসংক্রান্ত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্টনস এই তথ্য জানিয়েছে। তারা বলছে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ওই এলাকায় ৯৮টি লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় ১২ কোটি ২৯ লাখ পাউন্ড মূল্যের প্রপার্টি কিনেছেন বাংলাদেশিরা। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় এক হাজার ৫৬১ কোটি টাকা।
মন্ত্রী জানে, দুদক জানে না
২০২১ সালের জুন মাসে খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল জানান যে কানাডায় ২৮ জন বাংলাদেশির বাড়ি কেনার তথ্য আছে তার কাছে। তিনি তখন জানান, ‘‘ওই ২৮ জনের চারজন মাত্র রাজনীতিবিদ, বাকিরা সরকারি কর্মকর্তা। কিন্তু দুদক সেই তথ্য নিয়ে আগে কাজ করেনি। সংবাদ মাধ্যমে এছাড়াও অষ্ট্রেলিয়া,মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের সম্পদের তথ্য ছাপা হয়।
কানাডায় ‘বেগম পাড়া’ বলে পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশিদের আবাসিক এলাকা। সেখানে বাংলাদেশি প্রবাসীদের একাংশ বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনেক দিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। সম্প্রতি কানাডা বিদেশিদের বাড়ি কেনার ওপর দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
দুদক কী করে
দুদকের মানিলন্ডারিং অনুবিভাগ থেকে পাওয়া আংশিক তথ্য মতে, মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত এপর্যন্ত মোট ১১৭টি মামলা দায়ের হয়েছে, এর মধ্যে ৮৩টি মামলার তদন্ত চলছে। ৩২টি মামলায় চার্জশিট ও দুটি মামলায় ফাইনাল রিপোর্টসহ ৩৪টি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে, তদন্তাধীন ৮৩টি মামলায় ১১ জন আসামি গ্রেফতার হয়েছে।
আরও পড়ুন…শীতের সঙ্গে স্বাস্থ্যগত সমস্যার করণীয় কি
এই বিভাগের তথ্যে দেখা গেছে, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, হংকং, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার করা হয়েছে। পাচারের ধরনের ক্ষেত্রে দুদকের তিনটি মামলার ক্ষেত্রে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচার করার বিষয় তদন্তে পাওয়া গেছে। অন্যান্য ক্ষেত্রে হুন্ডি, ট্রেড বেইজড মানিলন্ডারিং না নগদ টাকা করা হয়েছে তা দুদক এখনো তদন্ত করে নির্ধারণ করতে পারেনি।
তবে ২০২০ সালে হাইকোর্টে দাখিল করা দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, দুদক ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্থ পাচারের অপরাধে ৪৭টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে ও ৮৮টি মামলা তদন্ত করছে। পাচারের তুলনায় সামান্য অর্থ তারা ফেরতও এনেছে।
দায় কার?
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তবে শুধু দুদক নয়, এটা প্রতিরোধের দায়িত্ব বাংলদেশ ব্যাংক, এনবিআর, সিআইডির। হাইকোর্টের এইসব ঘটনা তদন্তে বার বার নির্দেশ দেওয়া প্রমাণ করে যে, যাদের এটা প্রতিরোধের দায়িত্ব তারা ঠিকমত দায়িত্ব পালন করছেন না।’
তার কথা, ‘এর অনেক কারণ থাকতে পারে। অর্থসংক্রান্ত অপরাধ ধরার মতো সক্ষমতা না থাকা আবার দুদক আইনেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এগুলো হয়তো যুক্তি হতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, দুবাইয়ের ঘটনায় যা দেখলাম যারা অর্থ পাচার করে সেখানে সম্পদ গড়েছেন তারা সবাই প্রভাবশালী। তারা রাজনৈতিকভাবেও প্রভাবশালী। আইনে আছে, আন্তর্জাতিক আইনে আছে তারপরও তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ হয় না। বিষয়টি এখন ধরলে হাত পুড়ে যাবার মতো অবস্থা হয়েছে।’
আর দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম বলেন, ‘সংবাদমাধ্যম তথ্য দিতে পারে। কিন্তু সেই সব তথ্য আমাদের সঠিকভাবে আইনগত প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করতে হয়। দেশের বাইরের তথ্য আনতে হলে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স-এর আওতায় আনতে হয়। এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।’
তার কথা, ‘আমরা প্রথমে তথ্য সংগ্রহ করে তা যাচাই বাছাই করি। তথ্য সঠিক হলে আমরা অভিযোগ গঠন (মামলা) করি। তারপর আবার তদন্ত এবং চার্জশিট হয়। তথ্য প্রমাণ সঠিক না হলে তো মামলা প্রমাণ করা যায় না।’ ‘আমাদের সংবাদ মাধ্যম থেকে যেরকম তথ্য পাই। তেমনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকেও অভিযোগ পাই।’
আরও পড়ুন…নতুন রোমান্সে দিশা পাটানি!
‘হাইকোর্ট সর্বশেষ যে দুইটি বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন সেই আদেশের সার্টিফায়েড কপি আমরা পাইনি। পেলে তদন্ত শুরু হবে। তবে আমি কমিশনকে মৌখিকভাবে জানিয়ে দিয়েছি, জানান এই আইনজীবী। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণের হয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হারুন উর রশীদ স্বপন। এই প্রতিবেদনের সব ধরনের দায়ভার ডয়চে ভেলের।
ইবাংলা/জেএন/১৬ জানুয়ারি, ২০২৩
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.