বায়ু দূষণে দেশে ২ লাখ মানুষের মৃত্যু

আমিনুল ইসলাম, ঢাকা

দেশে মারাত্মক বায়ু দূষণের ফলে শ্বাসযন্ত্রের রোগসহ বিভিন্ন রোগে প্রায় দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুদূষণ শুধু স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নয়, এটি অর্থনৈতিক এবং ইকোসিস্টেমের ঝুঁকিরও কারণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে বায়ুদূষণ রোধ করা সম্ভব।

চলতি বছরের ১১ মাসে বায়ুমান সূচকে বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক দূষণের মাত্রায় বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় এবং ঢাকা নগরী চতুর্থ অবস্থানে থাকলেও বর্তমানে এক নন্বর অবস্থানে রয়েছে। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মানুষের জন্য এটি একটি দুঃসংবাদ।

শীতকালে আন্তঃসীমান্ত গতিশীলতার বাতাসে দূষিত বায়ুকণার প্রভাব সর্বোচ্চ থাকে যা বাংলাদেশে ইন্ডিয়ান বেল্টের কারণে উত্তরদিকে প্রবাহিত হয়ে ঢাকা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছায়। গবেষণায় আরও বলা হয় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার, বিকলাঙ্গতা, শ্বাসযন্ত্রের দুর্বলতা জনিত কারণে মৃত্যু, স্ট্রোক, ফুসফুস ক্যান্সার, ডায়াবেটিস সহ নিউমোনিয়ার মত ছোঁয়াচে রোগের কারণও বায়ু দূষণ।

বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশগুলোর মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ। আর সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সাম্প্রতিক গাইডলাইনের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস এমনটা জানিয়েছে।বায়ু দূষণে বাংলাদেশের পরেই রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার আরও দুটি দেশ পাকিস্তান ও ভারত।

ডব্লিউএইচও’র মতে, ঘরে-বাইরে বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মারা যায় ২০ লাখ মানুষ।এতে বাতাসে ভাসমান কণা পিএম১০ ও পিএম২.৫, ওজোন, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড ইত্যাদির বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।পরিবেশবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, দূষণ কমাতে অবিলম্বে তৎপর না হলে শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের ক্যান্সারের মতো রোগ আরও বিপজ্জনক আকার নিতে পারে।

বর্ষাকালে বৃষ্টির কারণে বায়ুদূষণ কম হওয়ার কথা থাকলেও চলতি বছর ঢাকায় তা মারাত্মক পর্যায়ে যায়। বায়ুদূষণে প্রথম অবস্থানে ছিল আবদুল্লাহপুর, দ্বিতীয় গুলশান, তৃতীয় মিরপুর, চতুর্থ শাহবাগ। শুষ্ক মৌসুমে এই দূষণ আরও ভয়াবহ হতে পারে। এমনকি জরুরি অবস্থায় পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি রাজধানীর পানি, বায়ু ও শব্দদূষণ পরিবীক্ষণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রথম ডাটা ভ্যালিডেশন কর্মশালায় এই তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়, শব্দদূষণও বেশি হয় রাজধানীর উত্তরার আবদুল্লাহপুরে, এরপর মিরপুর ১০ নম্বর, তৃতীয় অবস্থানে আছে মতিঝিল, চতুর্থ শাহবাগ এবং পঞ্চম গুলশান। বুড়িগঙ্গা নদীর শ্যামপুরের ট্যানারি এলাকায় বায়ুর সঙ্গে শব্দদূষণও অনেক বেশি রেকর্ড করা হয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের ১৬ নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ। এ ছাড়া দেশের আরও তিনটি শহর ও এলাকা রয়েছে ২০২০ সালের শীর্ষ ১০০ দূষিত শহরের মধ্যে। এরপর ৪২টি শহর নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে চীন। তৃতীয় অবস্থানে থাকা পাকিস্তানের দূষিত শহরের সংখ্যা ছয়।

গবেষণায় জানা যায়, বাহ্যিক বায়ু দূষণের কারণ হলো, নির্মাণ কার্যক্রম (৩৮%), প্লাস্টিক বর্জ্য পোড়ানো (২২%), শিল্প প্রক্রিয়াজাতকরণ (১৭%), ইট ভাটা (১০%), জীবাশ্ম জ্বালানী দহন, সড়ক পরিবহন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ৮%।তাছাড়াও অভ্যন্তরীণ কারণগুলো হলো রান্নার চুলা থেকে নিঃসৃত ধোঁয়া ৪১%, সিগারেট থেকে নিঃসৃত ধোঁয়া ২৫%, নর্দমা নিষ্কাশন ১৫%, রেডন গ্যাস ও অন্যান্য দূষণকারী পদার্থ ১০%। গবেষণা প্রতিষ্ঠান এসডোর আলোচনায় জানা যায় যে, মৌসুম পরিবর্তন ও বাতাসের আন্তঃসীমান্ত গতিশীলতা বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ।

বায়ু দূষণ রোধে করনীয়:
১) প্রতিদিন দুই বার রাজধানীর রাস্তা ঝাড়– দিতে হবে এবং সপ্তাহে একদিন রাস্তা পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে।
২) সারাদেশের রাস্তা ধোঁয়ার জন্য ১০০টি গাড়ী আমদানি করতে হবে। রাস্তা পরিষ্কার করার ট্রাক প্রস্তুতকারী কোম্পানীসমূহ যেমনÑমান-জার্মানি, মারসিডেস-জার্মানি,ডুভেলো-ইতালি, বেমা-জার্মানি, থোমে-বোরমান। প্রতিটি নতুন গাড়ির মূল্য দেড় কোটি থেকে তিন কোটি টাকা এবং পুরাতন গাড়ির মূল্য বিশ লক্ষ থেকে ৬০ লক্ষ টাকা।

৩) রাস্তা পরিস্কারের জন্য সিটি কর্পোরেশন যেভাবে নাগরিকদের কাছে বিভিন্ন সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করে ঠিক তেমন ভাবে প্রতি পরিবার থেকে ৫ বছর ২০ টাকা সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করা যেতে পারে।

৪) বায়ু দূষণ রোধের পুরো কার্যক্রম তদারকি করার জন্য আলাদা বিশেষজ্ঞ টিম গঠন করতে হবে এবং সমসময় কার্যক্রম তদারকি করতে হবে।

৫) ঢাকা নগরী ও তার আশেপাশে গাছপালার পরিমাণ ব্যাপক হারে কমে গেছে। অনতি বিলম্বে নদীর পাড়, রাস্তার পাশে, বিভিন্ন সরকারি জায়গায় পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপন করতে হবে ও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ভবন ও বাসা-বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় ও ছাদে মানুষকে সচেতন করার মাধ্যমে বাগান গড়ে তুলতে হবে।

৬) বায়ুদুষণের মাত্রা কমিয়ে আনার জন্য সরকার, সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনা আবশ্যক।

৭) নগরবাসীর স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করতে অচিরেই বায়ু দূষণের উৎসসমূহ বন্ধ করতে হবে। বায়ু দূষণের সকল উৎস বন্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বায়ু দূষণে জড়িত দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

৮) রাজধানীর বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নিয়মিতভাবে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করতে হবে এবং জনদুর্ভোগ লাঘবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা এবং তা নিয়মিত মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে।

৯) সনাতন পদ্ধতির ইটভাটাগুলোকে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ইটভাটায় রূপান্তর করা গেলে ৭০-৮০% দূষণ কমানো সম্ভব। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন বন্ধকরণ, রাস্তা নিয়মিত পরিষ্কারকরণ, পানি ছিটানো, নির্মাণ কাজ চলাকালে পানি ছিটানো এবং নির্মাণ সামগ্রী আচ্ছাদন দ্বারা আবৃতকরণ, কঠোর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে।

১০) অভ্যন্তরীর কক্ষের অর্থাৎ সাধারণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের বায়ু দূষণের পরিমাণ বাইরের বায়ু দূষণের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ গুণ বেশি হয়ে থাকে।

ইবাংলা /আমিন/১৩ ডিসেম্বর

Contact Us