কেন মাহফিলে এত অরাজকতা!

মুফতী ফয়জুল্লাহ আমান

ওয়াজ মাহফিলের মৌসুম পুরো শীতকালকে বলা যায়। বহু আগে থেকেই এই মাহফিলের সূচনা। তবু সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে যে পরিমাণ ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে তার নজির হয়তো ইতিহাসের কোনোকালে কোনো দেশেই পাওয়া যাবে না।

বিশেষত মাহফিলকে কেন্দ্র করে যে বিচিত্র আয়োজন চলে তা এককথায় অন্যরকম। স্বতস্ফূর্তভাবেই প্রতিটি এলাকায় তরুণরা মাহফিল আয়োজন করে। এর জন্য চাঁদা তোলা হয়, বক্তা দাওয়াত করা হয়, প্যান্ডেল সাজানো হয়, দূর দূর পর্যন্ত মাইক লাগানো হয়, বক্তা ও অতিথিদের খাবারের আয়োজন, সাধারণ শ্রোতাদের জন্যও তবারকের আয়োজন। এভাবে বিরাট আয়োজন চলে প্রতিটি মাহফিলকে ঘিরে।

একেকটি মাহফিলের জন্য প্রতিটি পাড়া বা মহল্লার মানুষের এক মাস বা দুই মাস সময় দিতে হয়। বড় বড় আয়োজনের জন্য প্রায় এক বছর আগ থেকেই প্রস্তুতি চলে। বড় কোনো বক্তাকে দাওয়াত করতে হলে এক বছর আগ থেকেই সিরিয়াল নিতে হয়। তার বিশেষ ফরম পূরণ করা থেকে নিয়ে তার সব শর্ত পুরণের ব্যাপার থাকে।

এসব শর্তের ভেতর একটি হচ্ছে অগ্রিম বুকিং দেওয়ার জন্য হাদিয়ার একটা অংশ পরিশোধ করা। যাতায়াত ব্যবস্থা হিসেবে হেলিকপ্টার রাখতে হয় বড় বক্তাদের দাওয়াত দিতে হলে। যে সব বক্তা হেলিকপ্টারে করে ওয়াজ করতে যান তাদেরকে হেলিকপ্টার হুজুর বলা হয়। এমন হেলিকপ্টার হুজুর এই মুহূর্তে ১০ থেকে ১৫ জন হবেন। এই ১০-১৫ জন অবশ্য যারা অনেক বেশি হেলিকপ্টারে ওঠেন, তা না হলে মাঝে মাঝে হেলিকপ্টারে ওঠেন এমন বক্তার সংখ্যা অনেক বেশি হবে। সাকুল্যে আমাদের দেশে কত বক্তা আছে তার কোনো পরিসংখ্যান আজতক হয়নি। তবু ধারণা করা যায় কয়েক হাজার ছাড়িয়ে যাবে তরুণ উদীয়মান বক্তার সংখ্যা।

মূলত কোথাও কোথাও শ্রোতার চেয়ে ওয়ায়েজিনের সংখ্যা বেশি হয়ে যায়। যারা নিয়মিত ওয়াজ শোনেন তারাও ছোট খাট একটা বক্তা হয়ে যান। বলতে বলতে বক্তা, শুনতে শুনতেও বক্তা। স্টেইজে চান্স না পেলে এসব বক্তা টিকটক বানিয়ে স্যোশাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেন। এভাবে ওয়াজ নসীহত খুব সস্তা হয়ে গেছে। এটা খুব দু:খজনক। ওয়াজ মাহফিলের দ্বারা যে উপকার ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা আশা করতেন তা অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। বিশেষত সাম্প্রতিক সময়ে অনেক মূর্খ ভুঁইফোড় বক্তা মাহফিলের মঞ্চকে নাচ গান আর অনর্থক কৌতুকের মঞ্চ বানিয়ে ফেলেছেন।

অনেক বক্তা মাহফিলের ভেতর রাজনীতির শুরু করেন। দেশদ্রোহিতামূলক বক্তব্য দেন। জঙ্গিবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। সংখালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি সাধারণ মুসল্লিদের উত্তেজিত করার চেষ্টা করেন। নারীদের প্রতি অশালীন শব্দ চয়ন হতে দেখা যায় অনেক বক্তার বক্তৃতায়। শ্রুতিকটূ ও দৃষ্টিকটূ বক্তব্যের কারণে অনেক বক্তাকে তার ভক্তরাই ভাদাইম্যা নাম দেন। বক্তাও এই উপাধি পেয়ে খুব খুশি হয়ে যান। শিক্ষিত ভদ্র শ্রোতারা এসব কারণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন মাহফিলে গিয়ে ওয়াজ শোনা থেকে। তবু ইউটিউব ও ফেসবুক থেকে সব শ্রেণির মানুষই ওয়াজ শোনেন।

ওয়াজ আজকাল হেদায়াতের জন্য শোনেন না, শোনেন কিছুটা বিনোদনের জন্য। অবসর সময় কাটানোর জন্য। মাহফিলগুলো কিসসা কাহিনি আর কৌতুকের রঙ্গমঞ্চ হয়ে গেছে। অভিনব অঙ্গভঙ্গি আর রং ঢংয়ে মজলিস মাতিয়ে রাখেন বিচিত্র বক্তারা। সামান্য টাকার জন্য হেন কোনো ভঙ্গিমা নেই যা বক্তারা করতে পারেন না। সব ধরনের গানের সুর নকল করবেন। অভিনয় করবেন। কখনও কখনও যিকিরের তালে তালে নাচবেন। গালাগালি করবেন, অশ্লীল কথা বলবেন, সবই করবেন। এসব দেখে অনেকে দাবি করেন, সরকার যেন এসব মাহফিল নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে বিরোধে ফুসে ওঠেন বক্তারা। সরকার সাধারণত এধরনের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায় না। মূলত এটা দেখার দরকার আলেম সমাজের নিজেদেরই। দেশের বড় বড় আলেমরা উদ্যোগ নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত মাহফিলগুলো। যে সমস্ত ধর্মীয় সংগঠন রয়েছে তার কর্ণধারদের উচিত ওয়াজের নীতিমালা প্রণয়ন করা। কিন্তু এমন কোনো নীতিমালা এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি।

ওয়াজ মাহফিলে যারা ওয়াজ নসিহত করেন তারা সাধারণত বড় আলেম হন না। খুব সাধারণ আলেমরাই ওয়াজ করেন। বরং বেশ কজন বড় বক্তা আলেম পাসও করেননি। আলিয়া বা কাওমি মাদ্রাসার কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত সনদ হাসিল করতে সক্ষম হননি। অনেক বক্তা মসজিদের চাঁদা কালেকশন করতে করতেই বক্তা হয়ে গেছেন। রাস্তার ধারে বা ব্রিজের কাছে মাইক হাতে সকাল বেলা মসজিদের জন্য চাঁদা কালেকশনের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কাউকে, সে গলা ভাজতে ভাজতে বিরাট বক্তা হয়ে গেছে। এমন অনেক নজির রয়েছে।

বক্তা হওয়ার জন্য মূলত আমাদের দেশে প্রয়োজন হয় পর্যাপ্ত গলাবাজি আর সুন্দর কণ্ঠ। কিছু বক্তার যোগ্যতা কেবল তিনি অনেক খাটো, একজন বক্তা আছেন যিনি কুদরতীভাবে হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে জেগে দেখেন মেয়ে থেকে ছেলে হয়ে গেছেন। কিছু বক্তা আছেন নও মুসলিম। আড়াই ফুটি বক্তা, তিন ফুটি বক্তা, শিশু বক্তা এমন হরেক ব্রান্ডের বক্তা আছে। সত্যি দারুণ তামাশায় পরিণত হয়েছে এসব ওয়াজ মাহফিল।

অনেকে বলেন, বড় আলেমরা কেন ওয়াজ করতে যান না? যান না কারণ ভালো কোনো আলেম গিয়ে ওয়াজের লাইনে অবস্থান করা কঠিন। কেউ এ পেশায় ভালো করতে হলে তাকে অবশ্যই নিচে নামতে হবে। বানানো কিসসা কাহিনি বলে মাহফিল জমাতে হবে। কৃত্রিম সুর দিতে হবে। একাধিক বড় আলেমকে দেখা গেছে এভাবে মাহফিল জমাতে গিয়ে সাধারণ বক্তাদের মতই কিসসা কাহিনি শুরু করে দিয়েছেন। হাদিসের এক হাত কথাকে টেনে দশ হাত না বানালে মাহফিল জমে না।

ইতিহাস ঘেটে দেখা যাচ্ছে, ওয়াজের মাঠের এই বিশৃংখলা বহু পুরনো। সাহাবিদের যুগ থেকেই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। প্রিয় নবির সাহাবিদের সময়েই এমন অনেক বক্তা আবোল তাবোল বকে ওয়াজ করা শুরু করে। সাহাবিরা তাদের নিবৃত করার চেষ্টা করেন। প্রত্যেক যুুগেই বড় বড় আলেমরা মানুষকে এসব বক্তার বিষয়ে সচেতন করেছেন। ফাউল বক্তাদের বিষয়ে সচেতন করে বহু কিতাবও লেখা হয়েছে যুগে যুগে। এর মাঝে বিখ্যাত কয়েকটি বইয়ের নাম বলব।

ষষ্ঠ শতকের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও মুহাদ্দিস ইবনুল জাউযি রহ. লেখেন ‘আলকুসসাস ওয়াল মুযাককিরিন’ নামক তথ্যবহুল গ্রন্থ। অষ্টম শতকে হাফেজ ইরাকি রহ. লেখেন ‘আলবায়েস আলাল খালাস’। নবম শতকে হাফেজ সুয়ুতি রহ. লেখেন তার কালজয়ী গ্রন্থ ‘তাহযিরুল খাওয়াস’ নামক গ্রন্থ। ‘তাহযিরুল খাওয়াস’ বইটির নামের অর্থ সুশীল নাগরিকদেরকে বক্তাদের মিথ্যাচার থেকে সাবধানকরণ।

আমাদের সময়ে সেই তুলনায় বিজ্ঞ আলেমদেরকে ওয়াজের মাঠের বিশৃংখলা নিয়ে কম কথা বলতে দেখা যায়। কারণ এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কোনো বিদগ্ধ আলেম ওয়াজ মাহফিল সম্পর্কে কিছু বললে, তাকে নিয়ে চরম ট্রল হবার সম্ভাবনা আছে। কেউ হেনস্থা হতে চান না ট্রলবাজদের হাতে। কিন্তু সবাই যদি এভাবে দায়িত্ব আদায়ে অবহেলা করেন তাহলে দিন দিন দূরবস্থা বাড়তেই থাকবে। দেশের ধর্মীয় পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তেই থাকবে। তাই সচেতন আলেম সমাজ ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে ওয়াজের মাঠের অরাজকতা বন্ধে।

ইবাংলা / নাঈম/ ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১

Contact Us