বন্দরে এক কনটেইনারেই ১’শ কোটি টাকার গুপ্তধন
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা এ বছর এমন এক ‘গুপ্তধনের খোঁজ’ পেয়েছেন। এক কনটেইনারেই ১০০ কোটি টাকা কাগজের চালানে পাওয়া গেল চীন থেকে ছাপিয়ে আনা সিগারেটের প্যাকেটের জাল ব্যান্ড রোল।
সিগারেটের প্যাকেটে রাজস্ব আদায়ের স্মারক হিসেবে যে সরকারি ব্যান্ড রোল (স্ট্যাম্প) ব্যবহার করা হয় তা-ই বিদেশ থেকে ছাপিয়ে অভিনব কৌশলে কাগজের চালানে আনার দুটি অপচেষ্টা রুখে দিয়েছেন তারা। এ ধরনের একটি কনটেইনারেই ১০০ কোটি টাকার বেশি অবৈধভাবে আয় করতো সংঘবদ্ধ চক্র!
সূত্র জানায়, দেশে যত পণ্য আমদানি বা দেশ থেকে রফতানি হয় সব পণ্যের একেকটি কোড নম্বর আছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর)। হাজার রকমের পণ্যের ৩০ লাখের বেশি কনটেইনার (টিইইউ’স) এক বছরে হ্যান্ডলিং হয় শুধু চট্টগ্রাম বন্দরেই। এর মধ্যে দুইটি কনটেইনারে সম্প্রতি সিগারেটের প্যাকেটের জাল স্ট্যাম্প বা ব্যান্ড রোল পাচারের অপচেষ্টা রুখে দিয়েছে কাস্টম হাউস। দেশে ট্রেড ফ্যাসিলিটেড করার পাশাপাশি মিথ্যা ঘোষণা, কম শুল্কে পণ্য ঘোষণা দিয়ে বেশি শুল্কের পণ্য নিয়ে আসা, কম ওজন দেখিয়ে বেশি পণ্য নিয়ে আসা, মানি লন্ডারিং, চোরাচালানসহ নানা বেআইনি বিষয় দেখভাল করে কাস্টমস। এর মধ্যে কাগজের ছোট্ট চালানে বড় অংকের রাজস্ব হাতিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টা রুখে দেওয়ার ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে বন্দর-কাস্টমপাড়ায়। রীতিমতো এটাকে ‘গুপ্তধন’ আখ্যা দিয়েছেন অনেকে।
গত ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বাপ্পু এন্টারপ্রাইজের নামে চীন থেকে আর্ট পেপার ঘোষণায় আসা ২০ ফুট লম্বা এক কনটেইনারে ৩ কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজার পিস সিগারেটের জাল স্টাম্প পাওয়ার খবর জানান কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা। পণ্যচালানটি খালাসের লক্ষ্যে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মধুমতি অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড কাস্টম হাউস, চট্টগ্রামে গত ৯ ডিসেম্বর বিল অব এন্ট্রি (নম্বর: সি-১৯৯১৯২৪) দাখিল করে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের পোর্ট কন্ট্রোল ইউনিট (পিসিইউ) ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার আওতায় রফতানিকারক, রফতানিকারকের ওয়েবসাইট, পণ্য তৈরির দেশ, আমদানিকারকের ব্যবসায়ের ধরন ও ঠিকানা, পণ্যের বর্ণনা প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে পণ্যচালানটিতে অসত্য ঘোষণায় সিগারেটের প্যাকেটে ব্যবহারযোগ্য জাল স্ট্যাম্প থাকার বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা লাভ করে। পরবর্তীতে এ দফতরের অডিট ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্স (এআইআর) টিম জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে পণ্যচালানের বিল অব এন্ট্রিটি লক করে। যাতে কেউ খালাস নিতে না পারে।
এরপর বন্দরের ভেতরে নিয়ম অনুযায়ী পণ্য পরীক্ষা শুরু করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এআইআর টিম। কনটেইনারের ২০টি প্যালেটের মধ্যে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫টি প্যালেট দেখানোর পর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট গড়িমসি শুরু করে এবং একপর্যায়ে কায়িক পরীক্ষা শেষ করার অনুরোধ করে। ওই ৫টি প্যালেটে শুধুই আর্ট পেপার পাওয়া যায়। কিন্তু এআইআর টিম শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করতে চাপ দিতে থাকে। এরপর এআইআর টিমের সদস্যরা আরেকটি প্যালেট খোলে এবং সিগারেটের জাল স্ট্যাম্প খুঁজে পায়। অতঃপর এআইআর টিম কর্তৃক ২০টি প্যালেট শতভাগ কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন শেষে মোট ২৪৬ প্যাকেটে (প্রতি প্যাকেটে ২৬০ বান্ডিল এবং প্রতি বান্ডিলে ৫০০ পিস হিসেবে) ৩ কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজার পিস নিম্নস্তরের ১০ শলাকাবিশিষ্ট সিগারেটের প্যাকেটে ব্যবহারের উপযোগী হালকা খয়েরি রংয়ের জাল স্ট্যাম্প পাওয়া যায়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এস.আর.ও নং- ১৪৭-আইন/২০২০/১০৮-মূসক; তারিখ: ১১/০৬/২০২০ খ্রি. অনুযায়ী নিম্নস্তরের সিগারেট স্ট্যাম্প এর রং হালকা খয়েরি যার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৯ টাকা থেকে ৬২ টাকা এবং যার বিপরীতে এসডির হার ৫৭ শতাংশ এবং মূসকের হার ১৫ শতাংশ। এই পণ্যচালানটি খালাস হয়ে গেলে এ স্ট্যাম্প ৩ কোটি ১৯ লাখ ৮০ হাজার নিম্নস্তরের সিগারেটের প্যাকেটে ব্যবহার করা যেত যার মাধ্যমে সরকার প্রায় ৯০ কোটি থেকে ১৪৩ কোটি টাকা রাজস্ব হারাতো।
সূত্র জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এস.আর.ও নং: ১৮১-আইন/২০১৯/৩৮-মূসক তারিখ: ১৩ জুন, ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ এর বিধি ১১ এর উপবিধি (৫) অনুযায়ী স্ট্যাম্প বা ব্যান্ডরোল দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করতে হয় এবং বিধি (৬) অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট কর্তৃক দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ এবং সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত কমিটি প্রতি ৩ (তিন) মাস অন্তর প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সিগারেট স্ট্যাম্প ও ব্যান্ডরোল সরবরাহ ও ব্যবহার আড়াআড়ি যাচাইপূর্বক প্রতিবেদন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মূসক বাস্তবায়ন শাখায় পাঠাতে হয়। ফলে এই জাতীয় পণ্য দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা অথবা বিদেশ থেকে আমদানি করার কোনো সুযোগ নেই।
পরের চালানটিও চট্টগ্রামের আমদানিকারকের
প্রথম চালানের এক সপ্তাহ পর ধরা পড়ে একই ধরনের আরেকটি চালান। সেটির আমদানিকারও চট্টগ্রামের, কোতোয়ালী থানাধীন জুবিলি রোডের ১২৮, কাদের টাওয়ারের চতুর্থতলার আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আরাফাত এন্টারপ্রাইজের নামে চালানটি বন্দরে আসে। ঘোষণা ছিল এফোর পেপার অল পারপাস, ডিডিজি এমডব্লিউ ৮০জিএসএম। এ চালানের বিপরীতে ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড জুবিলি রোড থেকে এলসি ইস্যু হয়েছিল গত ৮ নভেম্বর।
গত ২২ ডিসেম্বর এ চালানের কনটেইনাটি ফোর্স কিপ ডাউনের মাধ্যমে নামিয়ে বন্দরের ভেতরে নিয়ম অনুযায়ী এআইআর টিম পরীক্ষা শুরু করে। শতভাগ কায়িক পরীক্ষার লক্ষ্যে সব পণ্যের প্যাকেট কেটে দেখা হয়। এ সময় কনটেইনারটিতে থাকা ১২ প্যালেটের মধ্যে ৪টিতে ১২০ কার্টন (নিম্নস্তর ১০৫ কার্টন ও মধ্যম স্তর ১৫ কার্টন) বাংলাদেশের সিগারেটে ব্যবহারের উপযোগী হালকা সবুজ ও হালকা খয়েরি রঙের জাল স্ট্যাম্প পাওয়া যায়। প্রতি কার্টনে ২৭০ বান্ডিল এবং প্রতি বান্ডিলে ৫০০ পিস হিসেবে মোট ১ কোটি ৬২ লাখ পিস ব্যান্ড রোড বা স্ট্যাম্প ছিল এ চালানে। এর মধ্যে নিম্নস্তরের ১ কোটি ৪১ লাখ ৭৫ হাজার পিস এবং মধ্যম স্তরের ২০ লাখ ২৫ হাজার পিস রয়েছে। যার ওজন ১ হাজার ২০০ কেজি।
বাকি ১ হাজার ১৪০ কার্টনে এফোর সাইজের কাগজ পাওয়া গেছে যার মোট ওজন ১৪ হাজার ৩৮০ কেজি এবং নিট ওজন ১২ হাজার ৫৪০ কেজি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এসআরও (নম্বর ১৪৭-আইন/২০২০/১০৮-মূসক, তারিখ ১১/০৬/২০২০) অনুযায়ী নিম্নস্তরের খয়েরি রঙের সিগারেট স্ট্যাম্পের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ৩৯-৬২ টাকা। এর বিপরীতে এসডি’র হার ৫৭ শতাংশ, মূসকের হার ১৫ শতাংশ। মধ্যম স্তরের সিগারেট স্ট্যাম্পের রং হালকা সবুজ, যার খুচরা মূল্য ৬৩-১০১ টাকা। এসডি ৬৫ শতাংশ, মূসক ১৫ শতাংশ।
কাস্টম হাউসের ডেপুটি কমিশনার মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন রিজভী বাংলানিউজকে বলেন, দেশে শিল্পবিপ্লব, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, ভোগ্যপণ্যের সাপ্লাই চেন ঠিক রাখতে ট্রেড ফ্যাসিলিটেডের পাশাপাশি কাস্টম অ্যাক্ট ১৯৬৯ সহ প্রচলিত আইন ও বিধির বাইরে বেআইনি ভাবে চোরাচালান, পাচার, অবৈধ পণ্য আমদানি রুখে দিতে কাস্টম কর্মকর্তারা সক্রিয়। তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের সক্ষমতা, গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি চোরাকারবারিদের নতুন নতুন কৌশল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হচ্ছে। তারই ফলশ্রুতিতে বিদেশে ছাপানো জাল সিগারেটের ব্যান্ড রোলের চালানসহ একের পর এক অবৈধ চালান আটক করতে সক্ষম হচ্ছেন।
তিনি জানান, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মহোদয়ের নির্দেশে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে কাস্টম অ্যাক্ট ১৯৬৯ এবং প্রচলিত অন্যান্য আইন ও বিধি অনুযায়ী কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। ইতিমধ্যে ব্যান্ড রোল আটকের ঘটনায় বন্দর থানায় মামলা করা হয়েছে।
ইবাংলা /এইচ/ ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১