বাংলাদেশই বাংলা ভাষার রাজধানী
নিজস্ব প্রতিবেদক
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বের ৩৫ কোটি বাংলাভাষাভাষীর জন্য বাংলাদেশই হচ্ছে বাংলা ভাষার রাজধানী। বাংলাদেশই ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বাংলার এনকোডিং ও কীবোর্ড এর মান প্রমিত করেছে। শেখ হাসিনাই বাংলার ১৬টি টুলস উন্নয়নে ১৫৯ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছেন যার কাজ চলমান।
অন্যদিকে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম বাংলার জটিলতাকে ভয়ংকর করে তুলেছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে ইউনিকোডে বাংলা এনকোডিং করার সময় আমরা তার সদস্য ছিলাম না। তখন ভারতীয় বাংলাভাষাভাষীরা বাংলাকে দেবনাগরীর মতো করে এনকোডিং করে আমাদের ভাষার স্বাতন্ত্রকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছে। আমরা দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেও এর সমাধান করতে পারছিনা। তবে আমরাই বাংলাকে নিয়ে বিশ্বজয় করছি।
তিনি বলেন বাংলাদেশে প্রকাশনার জন্য বস্তৃত একটিই কীবোর্ড ও সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়। এখানে আসকি ও ইউনকোডের মধ্যে যে দেওয়াল আছে তা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। তারপরও ইউনিকোড কনভার্সনে যে জটিলতা হয় তার অপরাধ বাংলা ভাষাভাষীদের নয়; এই অপরাধ ইউনিকোডের। তাই এখনো আমরা ইউনিকোডের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরাই তাদের মেধা-মনন দিয়ে এই যুদ্ধ জয় করবে।
মন্ত্রী গতকাল (বুধবার ) রাতে ঢাকায় প্রযুক্তি বিষয়ক মাসিক পত্রিকা কম্পিউটার জগৎ এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত ডিজিটাল দুনিয়ায় বাংলা লিপি ব্যবহারের সংকট ও সমাধান নিয়ে অনুষ্ঠিত ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাযুক্তিক সমস্যাটার পেছনে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের দায় রয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন আমাদের ভাষা-কে একটি স্বতন্ত্র্য ভাষা হিসেবে গণ্য না করে আমাদেরকে ‘দেবনাগরীর’ অনুসারী করে প্রচণ্ড রকম ক্ষতি করা হয়েছে। এজন্যই এখনো আমাদেরকে নোক্তা নিয়ে যুদ্ধ করে বেড়াতে হচ্ছে। অথচ বংলা বর্ণে কোনে নোক্তা নেই।
ইউনিকোড যদি বাংলাকে বাংলার মতো দেখে এই সমস্যাগুলো সমাধান করে ফেলতো তাহলে যে সমস্যাগুলো এখন মোকাবেলা করতে হচ্ছে তা করতাম না। দেরি করে হলেও বাংলাদেশ ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে যোগ দিয়েছে ২০১০ সালে উল্লেখ করে কম্পিউটারে বাংলা ভাষার উদ্ভাবক জনাব মোস্তাফা জব্বার বলেন তার আগে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে ভারতীয় ভাষা পরিবারের যে এনকোডিংগুলো করা হয় তখন বাংলাভাষাভাষীরা ভূমিকা নিতে পারলে সংকট অনেকটাই উত্তরণ সম্ভব ছিলো।
এটিকে দেবনাগরীয় অনুসরণ করে যেভাবে কোডিং করা হয়েছে এটাকে কিন্তু আলাদা ভাষা না করে দেবনাগরীর একটি উপভাষা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার ফলে আজকে আমরা এই সমস্যাগুলোতে দারুণ ভাবে ভূগছি বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে আসকি, ইউনিকোড এবং প্রমিতের নির্দিষ্ট মান থাকলেও তার প্রয়োগ না থাকায় স্পেল চেকার, অভিধান, ওসিআর ইত্যাদিসহ বাংলা এনএলপি ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই এর প্রয়োগের বিষয়ে সংশ্লিষ্টদেরকে আরো সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
ডিজিটার প্রযুক্তি বিকাশের অগ্রদূত জনাব মোস্তাফা জব্বার ইউনিকোডে বাংলা লিপি ঢ-ঢ়, ড-ড়, য-য়-তে সমস্যা থাকাতে বড় তথ্য বিশ্লেষণ, সার্চ ইঞ্জিন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় এবং ইন্টারনেট অব থিংসে বেশ সংকট দেখা দিচ্ছে উল্লেখ করে বলেন মুদ্রণ জগতে ইংলিশ লিপির সাথে বাংলা লিপি’র সাইজের ক্ষেত্রে তারতম্য আছে।
বিভিন্ন বাংলা সফটওয়্যার ব্যবহারে বাংলা লিপিতে ঁ চন্দ্রবিন্দুর ক্ষেত্রে তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। যুক্তাক্ষরের ক্ষেত্রে সমস্যাটা প্রকট। বাংলা ডাটা মাইনিং এখনো ইন্ডাষ্ট্রির সমতুল্য হয় নাই। ল্যাংগুয়েজ মডেল করতে দেখা যাচ্ছে বাংলা করপাসে বেশ সমস্যা।
কম্পিউটার জগৎ-এর নির্বাহী সম্পাদক, মোহাম্মদ আব্দুল হক অনুর সঞ্চালনায় প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে অনুষ্ঠিত এই নীতি সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের ভাষা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, পরামর্শক মোহাম্মদ মামুন অর রশিদ।
আলোচনায় ভারত থেকে অংশ নেন এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের, কলা অনুষদ ডিন এবং ভাষা বিজ্ঞান চেয়ার, অধ্যাপক উদয় নারায়ন সিং। তিনি বলেন, ‘বাংলালিপির সঙ্গে একটা অদ্ভূত আত্মিক যোগাযোগ আছে। এটা এতো বেশি যে কোনো রকম পরিবর্তনের কথা বলতে গেলেই নানা রকম সমস্যার দেখা দেয়। এটা নিয়ে আমরা পাঁচ পা এগিয়ে চার পা পিছিয়ে যাচ্ছি। এ কারণে এই ভাষাকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশকেই নেতৃত্ব দিতে হবে।’
ওয়েবিনারে মনোনীত আলোচক হিসাবে আরো বক্তব্য রাখেন ডেটা সায়েন্স লেখক রাকিবুল হাসান, বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এএইচএম বজলুর রহমান ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নিপা জাহান।
উল্লেখ্য ইউনিকোডের শুরু ১৯৮৭ সালে অ্যাপল কম্পিউটারের উদ্যোগে। পরে মাইক্রোসফটসহ বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এ উদ্যোগে যুক্ত হয়ে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম গঠন করে। ১৯৮৮ সালে থাইল্যান্ডে অ্যাপলের একটি সম্মেলনে অংশ নেন আনন্দ কম্পিউটার্সের প্রধান নির্বাহী এবং বর্তমানে ডাক, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। ইউনিকোডের বাংলায় সে সময় ড়, ঢ়, য় ও ৎ—এই চারটি বর্ণ ছিলই না। জনাব মোস্তাফা জব্বার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং এগুলো যুক্ত হয়।
দেশের প্রথম অন লাইন বাংলা সংবাদ সংস্থা আবাস-এর চেয়ারম্যান সাংবাদিক জনাব মোস্তাফা জব্বার জানান বাংলা প্রকাশনা এক সময়ে কোলকাতানির্ভর ছিলো। এখানে টাইপফাউন্ড্রিও ছিলোনা। টাইপসেটার ও অন্যান্যপ্রযুক্তির কেন্দ্র ছিলো কোলকাতা। বঙ্গবন্ধু প্রথম ১৯৭২ সালে শহীদ মুনীর চৌধুরি উদ্ভাবিত কীবোর্ড অনুসরণ করে অপটিমা মুনীর টাইপরাইটার প্রবর্তণ করেন। এরপর প্রকাশনায় বাংলা আসে ও বাংলাদেশের প্রকাশনায় বিপ্লব আসে। তিনি বলেন বাংলাদেশ সেই নেতৃত্ত্ব ধরে রেখেছে ও আগামীতেও সেটি আরও দৃঢ়তার সাথে ধরে রাখবে।
ইবাংলা/ ই/ ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২