দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপিতে একটি মেরুকরণ চলছিল। এই মেরুকরণের মূল লক্ষ্য ছিল জিয়া পরিবারমুক্ত একটি বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়া এখন অসুস্থ। তিনি রাজনৈতিক দল পরিচালনা করতে অক্ষম। আর এ কারণেই দলের বিভিন্ন ভালো-মন্দ দেখভাল করা তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। এই বাস্তবতায় দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে। তিনি লন্ডনে পলাতক, একাধিক মামলায় দণ্ডিত আসামি।
তারেক জিয়া শুধু যে একাধিক মামলায় দণ্ডিত আসামি- এমনটি নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তার গ্রহণযোগ্যতাও তলানিতে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাকে দুর্নীতিবাজ, দুর্বৃত্ত এবং সন্ত্রাসীদের মদদদাতা মনে করা হয়। তার সঙ্গে জঙ্গিবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর সম্পর্কের কথাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে একে একে বিএনপির জনপ্রিয় নেতাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। এই বহিষ্কার কেন? এ নিয়ে বিএনপির মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। তবে বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে যে, বিএনপির ভাঙন চূড়ান্ত ধাপে এসে পৌঁছেছে। আর এই ভাঙনের প্রক্রিয়া হিসেবেই বিভিন্ন এলাকার জনপ্রিয় নেতাদেরকে বহিষ্কার করা হচ্ছে।
খুলনার জনপ্রিয় নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে বহিষ্কার করার পর বহিষ্কৃত হন তৈমুর আলম খন্দকার। সর্বশেষ বহিষ্কৃত হলেন আখতারুজ্জামান। আর এই সমস্ত বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে বিএনপির ভাঙন যেমন চূড়ান্ত হচ্ছে, তেমনি আসল বিএনপির আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় বিএনপির কোনো কোনো নেতা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আর এ কারণেই ভারত সফরে গিয়েছিল বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা। সেই সময় ভারত বিএনপিকে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছিল। এর মধ্যে একটি ছিল, জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করা। আর দ্বিতীয়টি ছিল তারেক জিয়াকে নেতৃত্ব থেকে আপাতত সরিয়ে দেওয়া। শুধু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেই নয়, বিভিন্ন সময় বলা হচ্ছে যে, বিএনপিকে যদি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিকশিত করতে হয়, তাহলে এই দলের মধ্যে থেকে তারেক জিয়াকে বাদ দিতে হবে। তারেক জিয়া এবং খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে একটি গণ-গ্রহণযোগ্য বিএনপি গঠন না করা হলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিএনপি কোনোরকম সমর্থন এবং সহযোগিতা পাবে না। শুধু আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেই নয়, জাতীয়ভাবেও বিএনপির গ্রহণযোগ্যতা এখন তলানিতে। বিএনপি শুধুমাত্র খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং নিজেদের ইস্যু ছাড়া জন-গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করতে অক্ষম একটি রাজনৈতিক দলে পর্যবসিত হয়েছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির মধ্যে হয়েছে ব্যাপক মনোনয়ন বাণিজ্য। একটি বিরোধী দল হিসেবে যে দায়িত্বশীল ভূমিকা থাকে, সেটি পালন করার ক্ষেত্রে বিএনপি সীমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আর এই সমস্ত বাস্তবতাতেই বর্তমান বিএনপির নীতি-কৌশল একটি সঠিক বিরোধী দলের নীতি-কৌশলের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই অনেকে মনে করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপিতে মতবিরোধ তীব্র আকার ধারণ করেছে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে। এই প্রক্রিয়ায় অনেকে মনে করেছিলেন যে, বিএনপির অংশগ্রহণ করা উচিত। বিশেষ করে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার হোক না হোক, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠিত না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু বিএনপি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দল হিসেবে যে ভূমিকা, সে ভূমিকা পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে। এই ভূমিকাহীন আচরণে বিএনপির মধ্যেও এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। বিএনপির নেতারা এখন খোলাখুলিভাবেই তাদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলছেন। যারাই সাংগঠনিকভাবে জনপ্রিয় এবং দলের জন্য চিন্তিত, তাদেরকেই দল থেকে ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে সারাদেশে জনপ্রিয় নেতারা নিজেদেরকে সংঘবদ্ধ করার সুযোগ পাচ্ছেন। সামনের দিনগুলোতে আরো কিছু বহিষ্কার এবং আরো কিছু দলত্যাগের মাধ্যমেই বর্তমান বিএনপি ভেঙে একটি নতুন বিএনপি যে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে, তার রূপরেখা তৈরি হয়েছে।
ইবাংলা/ নাঈম / ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২২