দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার স্বর্গরাজ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান কালব

আমিনুল ইসলাম :

অনিয়ম দুর্নীতি আর লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে সমবায় ভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান দি কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লীগ অব বাংলাদেশ লিঃ (কালব)। কালব’এর ব্যবস্থাপনা কমিটি এখন প্রতিমাসে অন্তত ৩ কোটি টাকার লোকশানি প্রতিষ্ঠানে পরিনত করেছে, দেশের ক্রেডিট ইউনিয়ন সমূহের এ শীর্ষ প্রতিষ্ঠানটিকে। সমবায় অধিদফতরের কর্মকর্তারাও অদৃশ্য কারণে একেবারেই নির্বিকার ভূমিকা পালন করছেন।

কালব’এর সাবেক চেয়ারম্যান সায়মন এ. পেরেরা ৭৭ কোটি টাকা একটি ভূয়া কোম্পানির নামে অপ-বিনিয়োগের মাধ্যমে কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়ার পর চরম লোকশানের মুখে পতিত হয় কালব। কিন্তু তার পরবর্তী ৩ বছর এবং বর্তমানের চলমান ব্যবস্থাপনা কমিটি তহবিল তছরূপ এবং লুটপাটের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে। ফলে ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে
লোকশানের অংক।

পূর্বের মতো একইভাবে অকারণ ও অলাভজনক খাতে বিপুল অংকের টাকা অপ-বিনিয়োগের মাধ্যমে বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি কৌশলে নিজেদের পকেট ভর্তি করছেন আর সেইসঙ্গে ক্রমাগত লোকশানের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন সদস্যদের গচ্ছিত প্রায় ৮০০ কোটি টাকার সঞ্চিত তহবিলের এ সমবায় প্রতিষ্ঠানিকে।

কালব’ এর ঘনিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান জোনাস ঢাকী, ভাইস চেয়ারম্যান ফাহমিদা সুলতানা সীমা, সেক্রেটারী আলফ্রেড রায় এবং ট্রেজারার এম. জয়নাল আবেদীন গং প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শক্তিশালি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন আর নিজেদের পকেট ভরার জন্যে অপ-বিনিয়োগের বিভিন্ন পন্থা তারা খুঁজে বের করেন এবং বোর্ড সভায় সেগুলো সহজেই অনুমোদন করিয়ে নেন।

সম্প্রতি লাভজনক ব্যবসার কাহিনী শুনিয়ে কালব চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, সেক্রেটারী এবং ট্রেজারারের উত্থাপিত প্রস্তাব অনুযায়ী দিনাজপুরে চাল কিনে গুদামজাত করার জন্য ৫ কোটি টাকা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় পাস করে নেয়।

কাজ সম্পাদনের জন্য চেয়ারম্যান জোনাস ঢাকীকে আহবায়ক, ডিরেক্টর একরামুল হক’কে সদস্য সচিব এবং ডিরেক্টর বাবলু কোড়াইয়া’কে সদস্য করে ৩ সদস্য বিশিষ্ট চাল ক্রয় কমিটি গঠন করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী ক্রয় কমিটিতে একজন সিনিয়র ম্যানেজার অন্তর্ভূক্ত রাখার কথা থাকলেও এ ক্রয় কমিটিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই সিনিয়র কর্মীদের পক্ষ থেকে কাউকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি।

চাল ক্রয় কমিটির সদস্য সচিব একরামুল হক’কে দিনাজপুরের পাইকারী মোকামে চালের দরদাম যাচাই বাছাইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। ডিরেক্টর একরামুল হক স্থানীয় সিন্ডিকেট বা দালাল চক্রের মাধ্যমে চালের দরদাম চুড়ান্ত করে ফেলেন। তার কথা মতো ক্রয় কমিটি ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ৩ লাখ ৯০ হাজার কেজি চিনিগুড়া চাল কিনে দিনাজপুর শহরের পুলেরহাটে একটি গোডাউন ভাড়া করে সেখানে গুদামজাত করে রাখেন।

ক্রয়কৃত চালের ক্রয়মূল্য দেখানো হয় ৭৭ টাকা এবং পরিবহন বাবদ ২ টাকা হিসাবে মোট ৭৯ টাকা প্রতি কেজি। অথচ সেই সময় দিনাজপুর রাইসমিলগুলোতে এক্সপোর্ট কোয়ালিটির চিনিগুড়া চালের পাইকারি দর ছিল ৭৫ টাকা প্রতি কেজি। এখানে প্রতি কেজিতে অন্তত ২ টাকার সন্দেহজনক গড়মিল লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

অনেকের ধারণা এই ৩ লাখ ৯০ হাজার কেজি চালের প্রতিকেজিতে ২ টাকা হিসেবে অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে মোট ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকা ক্রয় কমিটির সদস্যরা চাল কেনার সময়ই পকেটস্থ করেছেন। বাজারে এক্সপোর্ট কোয়ালিটির সর্বোচ্চ মানের চিনিগুড়া চালের দাম ৭৫ টাকা কেজি থাকা সত্বেও ক্রয় কমিটি ৭৭ টাকা দরে একই স্থান থেকে নিম্নমানের চাল কেন কিনলেন তা সুষ্ঠু তদন্তে বের হয়ে আসবে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো ৩ মাসের বেশি সময় ধরে চিনিগুড়া চাল ষ্টক করে রাখলে তার গুনগত মান বিনষ্ট হতে থাকে। অথচ কালব কর্তৃপক্ষ গত ৭ মাস ধরে চালগুলোকে গুদামবন্দি করে ফেলে রেখেছেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, পরিবহন খরচসহ ৭৯ টাকা কেজি দরে কেনা এই চাল বাজার দরের অতিরিক্ত হওয়ায় তা ক্রয় কমিটি কারও কাছেই বিক্রি করতে পারছে না। ৭ মাস গুদামে পড়ে থাকার পর ৭৯ টাকা কেজি দরে কেনা চালের এখন সর্বোচ্চ দাম উঠেছে ৬০ টাকা প্রতি কেজি। গুনগত মানের সাথে ক্রমান্বয়ে এই দাম আরও কমতে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে ।

ক্রয়কৃত ৩ লাখ ৯০ হাজার কেজি চালের ক্রয়মূল্য ৭৯ টাকা কেজি দরে মোট ৩ কোটি ৮ লাখ ১০ হাজার টাকা। বিনিয়োগকৃত এই টাকার সাথে ১২ শতাংশ হারে ৭ মাসের সুদ ২১ লাখ ৬৬ হাজার ৭০০ টাকা যুক্ত হলে মোট ক্রয়মূল্য দাঁড়াবে ৩ কোটি ২৯ লাখ ৬৬ হাজার ৭০০ টাকা। বর্তমানে ৬০ টাকা প্রতি কেজি বিক্রি হলে মোট বিক্রিমূল্য আসবে ২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। নিট লোকশান দাঁড়াবে ৯৫ লাখ ৬৬ হাজার ৭০০ টাকা।

লোকশানের পরিমান ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকবে। এ বিষয়ে কাউ এর চেয়ারম্যান জোনাস ঢাকী’র সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে বলেন আমি আপনার সঙ্গে কোন কথা বলবো না। এরপর ট্রেজারার জয়নাল আবেদীন এর সাথে মুঠোফোনে চাল ক্রয়ের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথমবার ব্যবসায় নেমেছি লাভ হবে না লোকসান হবে ঠিক বুঝতে পারছিনা।

তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, চাল গুলো এখনো বিক্রয় করা সম্ভব হচ্ছে না। কুচিলা বাড়ি রিসোর্টে বারের লাইসেন্স বাবদ একটি দালাল চক্রের সঙ্গে ৭ কোটি টাকা চুক্তি হয়েছে তবে লাইসেন্স এখনো পাননি বলে জানান।

এই অপরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমূলক অপ-বিনিয়োগের সাথে জড়িত কালব চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, সেক্রেটারী, ট্রেজারার এবং ক্রয় কমিটিসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির সকলের বিরুদ্ধে দুদক, সিআইডিসহ অন্যান্য বিভাগের মাধ্যমে তদন্ত এবং কঠিনতম ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী উঠেছে।

ই-বাংলা.প্রেস/ আইএফ/ ২৪ আগস্ট ২০২১

Contact Us