ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পেয়েও শঙ্কিত মমতা খাতুন

বগুড়া প্রতিনিধি

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১০৪০ তম মেধা তালিকায় থেকেও বগুড়া সদরের ফাঁপোর ইউনিয়নের বেলগাড়ী গ্রামের মমতা খাতুন অর্থের অভাবে শঙ্কিত যে, তিনি ভর্তি হয়ে পড়াশোনা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারবেন কিনা।

বগুড়া সদরের বেলগাড়ি গ্রামে মঞ্জুয়ারা বেগম ২০০২ সালের ১৫ মার্চ জন্ম দেন কন্যা সন্তান। মা স্নেহ ভালবাসায় নাম দেন মমতা। মমতাকে জন্ম দেয়াই মঞ্জুয়ারার জীবনে নেমে আসে কালো অন্ধকার। যেন মহা অন্যায় করেছে কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে।

এক কন্যা ও দুই পুত্র সন্তানের পর জন্ম হয় মমতা’র। কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ায় পিতা: রমিজ উদ্দিন রাগে ক্ষোভে কয়েকদিন পরেই তার প্রতিবন্ধী এক ছেলে, সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া কন্যা মমতা ও স্ত্রীকে রেখে বড় দুই ছেলে-মেয়ে কে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান অজানার উদ্দেশ্যে। একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তি ছিলেন রমিজ উদ্দিন। স্বামী চলে যাওয়ায় প্রতিবন্ধী ছেলে ও সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া কন্যাকে নিয়ে বিপাকে পড়েন মঞ্জুয়ারা। একেতো প্রতিবন্ধী ছেলে অপরদিকে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া কন্যা। দারিদ্রতার সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে এদের জীবন পার করতে হয়।

বাবা ফেলে গেলেও কিন্তু জীবনের চাকা থেমে থাকেনি। কোলের সন্তান নিয়েই মঞ্জুয়ারা ঢালাই কারখানাতে কাজ শুরু করেন। যতটুকু উপার্জন করেন তাই নিয়ে দু-একবেলা খেয়ে-না খেয়ে প্রতিবন্ধী ছেলে ও মমতাকে লালন-পালন করতে থাকেন। বড় হতে থাকে মমতা, পাঁচ বছর বয়সে ভর্তি করে দেন বেলগাড়ী ব্র্যাক স্কুলে, সেখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে, প্রাথমিক লেভেলেও ফলাফল ভাল করেন। প্রতিবেশী মনির সম্পর্কে মামা তার পড়াশোনার পাশাপাশি মমতাকে বিনা পয়সায় লেখাপড়া করান এবং তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি দেখে তাকে লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগী করে তোলেন মনির।

মনির বলেন যে, ‘মমতার ভিতরে অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও আগ্রহ দেখে আমি উদ্বুদ্ধ হই মমতাকে প্রাইভেট পড়াই কোনরূপ টাকা ছাড়াই এবং তার পড়াশোনার জন্য আমার সাধ্যমত আর্থিকসহ সব ধরনের সহযোগিতা করি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারিনি, কিন্তু মমতার ভিতরে লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ানোর চিন্তা লালন করতে থাকি। আজ তা বাস্তবে রূপ দিতে যাচ্ছে। কিন্তু তার আর্থিক অনটনের কারণে আমিও শঙ্কায় আছি।

ষষ্ঠ শ্রেণীতে ফাঁপোর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে এসএসসি পাস করেন। দারিদ্রতার চরম পর্যায়ে থাকলেও মমতা সাহস হারাননি। অনেক কষ্টে মানুষের সহযোগিতা নিয়ে টাকা সংগ্রহ করে আদর্শ ডিগ্রী কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয় মমতা। তার পড়াশোনার আগ্রহ ও মনোযোগী দেখে কলেজের শিক্ষকেরাও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা ও পরামর্শ দেন মমতাকে। বিশেষ করে অর্থনীতি বিভাগের সবুজ স্যার সব ধরনের সহযোগিতা করেন মমতাকে।

কিছু আগে বাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগ নিয়েছে, তার আগে বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না, কাঁচের বোতলে কেরোসিন তেল তুলে আলো জ্বালিয়ে পড়াশোনা করেছেন মমতা খাতুন। অবশেষে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন মমতা। তার তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। সেই লক্ষ্যে ফর্ম তোলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, ভর্তি যুদ্ধে নেমে পড়েন মমতা, শেষে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মমতার জন্য ছিল এটা একটা আকাশকুসুম কল্পনা। এই আকাশকুসুম কল্পনা বাস্তব হতে চলছে। কিন্তু মমতার চিন্তা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবেন! যেখানে দু’বেলা ভাল খাবার পায়না, নাই কোনো ভালো কাপড়। এমতাবস্তায় ঢাকা শহরে কিভাবে থাকবেন, লেখাপড়ার খরচ কোথায় পাবেন, তার মা কিভাবে থাকবে, কি খাবে, এমন হাজারো চিন্তা মমতার মাথায়। এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মমতা।

মমতা বলেন ‘আমরা শুধু সকালবেলা ভাত রান্না করে খাই, কিছু থাকলে দুপুরে খাই, অনেক সময় দুপুরে ভাত নষ্ট হয়ে যায় ওই ভাত আমরা খাই, রাতে খাবার পাইনা। মা তো অসুস্থ, আর কাজ করতে পারেন না। কিছুদিন আগে ভাই মারা গেছে।’
মমতাকে দেখলেই যে কেউ অনুমান করতে পারবে যে, খাদ্যাভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে মেয়েটি। তার মায়ের স্বাস্থ্যও ভালো নাই। এদের জন্য ভালো খাবার ও চিকিৎসা দরকার। মমতা’র কাছে তার ভবিষ্যৎ ইচ্ছা বা স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি লেখাপড়া করে মনুষ্যত্ব অর্জন করতে চাই। লেখাপড়া শেষে একটা ভালো চাকরি করে দুর্নীতি রোধ করতে চাই।

আর আমি কন্যা সন্তান হয়েছি জন্মেছি বলে, অবহেলা করে বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন, আমি বাবার কোনদিন আদর পাইনি, এমনকি তাকে বাবা বলে ডাকতেও পারিনি। তাই সমাজে আমার মত যারা অবহেলিত আছে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে অবহেলিত সন্তানদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে চাই।

খবর পেয়ে ওই এলাকার ফাঁপোর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সহকারী অধ্যাপক মহররম আলী মমতার বাড়িতে ছুটে চলে যান, তাদের মিষ্টিমুখ করান এবং সকল ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন।

ইবাংলা / জেএন / ০১ জুলাই,২০২২

Contact Us