নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অনীহা

নাজমুল ইসলাম

একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতির এই মাহেন্দ্রক্ষণে বিজ্ঞানের সকল আবিষ্কারের মাতৃকা হচ্ছে বিদ্যুৎ। দৈনন্দিন জীবন-যাপন, অর্থনৈতিক উৎপাদন, যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই রয়েছে বিদ্যুতের অত্যাবশ্যকতা।

বিদ্যুৎ একটি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি অন্যতম সঞ্চালক ব্যবস্থা। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনা উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় এখনো বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) কর্তৃক প্রকাশিত ‘এনার্জি আর্কিটেকচার পারফরম্যান্স ইনডেক্স- ২০১৭’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে বিদ্যুতের কাঠামোগত দক্ষতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের ১২৭ টি দেশের মধ্যে ১০৪তম।

আরও পড়ুন…চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা ১৫ সেপ্টেম্বর

২০১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে বিদ্যুতের মাথাপিছু উৎপাদন হল ৪০৭ কিলো ওয়াট আওয়ার যা দক্ষিণ এশীয় দেশ তথা ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলংকার মধ্যে সর্বনিম্ন।বর্তমানে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৪ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ৭৭ মেগাওয়াট উৎপাদন করা সম্ভব, যা মোট সক্ষমতার প্রায় ৩ শতাংশের মতো।

নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কতৃর্পক্ষের (স্রেডা) তথ্য অনুযায়ী গত ২০১৭ সালে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ছিল ২.৮৭ শতাংশ, যা এর আগের বছরে ছিল ২.৮৫ শতাংশ। অথচ ২০২০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নিধার্রণ করেছে সরকার। সমুদ্র সম্পদ ব্যবহার করে অনায়াসে এই লক্ষ্যমাত্রা অজর্ন করা সম্ভব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতিসংঘের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সবুজ শক্তি উৎপাদনে প্রায় ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হবে। এই খাতে সৃষ্টি হবে মিলিয়নের বেশি কমর্সংস্থান। তথ্যমতে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সামুদ্রিক ঢেউ ও জোয়ারের স্রোত ব্যবহার করে ৩৩৭ জিওয়াট (গিগাওয়াট) বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।

একই সময়ে ৩২০ জিওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বায়ু শক্তি ব্যবহার করে এবং ৪০০ জিওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে সৌর শক্তি ব্যবহার করে। চীন, ভারত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন যথাক্রমে ১০০ জিওয়াট, ২৫ জিওয়াট এবং ১১০ জিওয়াট সামুদ্রিক শক্তি থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। বতর্মানে বিশ্বব্যাপী বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রতি বছর ৩০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আরও পড়ুন…জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন সীমিত হওয়ায় লোড-শেডিং

তবে বাংলাদেশের এ খাতে অপার সম্ভাবনা থাকলেও যথেষ্ট নীতি সহায়তা এবং বিনিয়োগের অভাবে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। গণমাধ্যমের তথ্যমতে, টেকনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল এসডিএন বিএইচডি নামের মালয়েশিয়ান একটি কোম্পানি দক্ষিণ চট্টগ্রামে সামুদ্রিক ঢেউভিত্তিক একটি পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু আজ পযর্ন্ত সেই প্রস্তাব আলোর মুখ দেখেনি।

কোম্পানির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এটি একটি সবুজ উদ্যোগ, সব ধরনের দূষণমুক্ত এবং পরিবেশ দূষণকারী কাবর্ন-ডাই-অক্সাইড কমাবে। এই প্লান্টের প্রতি ঘণ্টায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৯০০ মিলিয়ন কিলোওয়াট। এদিকে প্রাকৃতিক কারণেই বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের অধীর সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এখানে বছরে তিনশ দিনেরও বেশি রোদ থাকে। ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে সোলার প্যানেল আনা হয়।

বাংলাদেশে সৌর বিদ্যুৎ সম্ভাবনাকে বাস্তব করতে ২০০৩ সাল থেকে কাজ করে আসছে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে ইডকল, গ্রামীণ শক্তি, ব্র্যাক, সৃজনী, ও ব্রিজ অন্যতম। ইনস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড (ইডকল) নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ সেক্টরে বিশ্বব্যাংক সামগ্রিক অর্থায়ন করে থাকে।

আরও পড়ুন…শিক্ষার্থীদের মন ভালো করতে পাশে আছে জবি কাউন্সিলিং সেন্টার

সরকারি মালিকানার এ প্রতিষ্ঠান সারাদেশে সৌর বিদ্যুৎ প্রসারের জন্য অর্থায়ন ও কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে আসছে। তবে এ খাতে যথেষ্ট অব্যবস্থাপনা ও ধীরগতি প্রতীয়মান হয়েছে যার ফলে বিতরণ ব্যবস্থা ব্যহত হচ্ছে।

বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনায় দেখা যায়,১৯৮২ সালে একটি প্রাথমিক গবেষণায় দেশের ৩০টি আবহাওয়া তথ্য স্টেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার বায়ুর গতি প্রকৃতি অনুযায়ী ঐ স্থানদ্বয় হচ্ছে বায়ু থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত স্থান।

এরপর আরও পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বায়ুশক্তি হতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২০০৫ সালে ফেনীর মহুরী নদীর তীর ও সোনাগাজী চরাঞ্চল ঘেঁষে খোয়াজের লামছি মৌজায় ৬ একর জমির উপর স্থাপিত হয় বাংলাদেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটি চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হলেও পল্লীবিদ্যুতের একটি ফিডারে যোগ হয়ে তা বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা হলেও মেটাতে ভূমিকা রয়েছে।

যদিও ২০০৭ সালে কারিগরি ক্রুটি, অব্যবস্থাপনা ও পর্যাপ্ত বাতাস না থাকায় এর কার্যক্রম বেশ কয়েকবছর বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে সংস্কার করে ২০১৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে তা পুনরায় চালু হয়। চালু হওয়ার পর ২০১৪ সালে মোট উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ২ লাখ ২ হাজার ৪শ ৩৯ ইউনিট। তখন গড় উৎপাদন ছিল দৈনিক ১৬ হাজার ৮৩০ ইউনিট।

বর্তমানে পিডিবির প্রজেক্টের আওয়তায় প্যান এশিয়া পাওয়ার সার্ভিস লিমিটেডের মাধ্যমে চারটি টারবাইন দিয়ে বাতাসকে কাজে লাগিয়ে ২২৫ কিলোওয়াট করে ৯শ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটির সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ০.৯০ মেগাওয়াট।

বাংলাদেশের অন্য আরেকটি বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়। ২০০৮ সালের পহেলা বৈশাখে এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ৬০০ গ্রাহকের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে বিতরণও করা হয়েছিল, যেখানে ছিল ৫০টি টারবাইন৷ প্রতিটির ক্ষমতা ২০ কিলোওয়াট করে৷ অর্থাৎ এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ১ মেগাওয়াট। যদিও পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ বিতরণের পর বেশ কয়েকবছর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দেশের সর্ববৃহৎ এ বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ ছিল, তবে তা আবার নতুন করে চালু হয়েছে।

আরও পড়ুন…ভর্তি ফরম বিক্রি করে গুচ্ছের ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় ৪৪ কোটি টাকা

এদিকে বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুশক্তি হতে ১৩৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে এবং ২০২১ সালের মধ্যেই বায়ু শক্তি উৎস হতে মোট ১১৫৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কোনো স্থানে বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পূর্বশর্তই হলো সেই স্থানের বায়ু প্রবাহের গতিবিধি ও পর্যাপ্ততা সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত দীর্ঘ মেয়াদে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা।

সে লক্ষ্যে উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের নিম্নবর্ণিত ৯ (নয়) টি স্থানে বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্য “উইন্ড রিসোর্স ম্যাপিং প্রকল্প” এর আওতায় বায়ু প্রবাহের তথ্য উপাত্ত (ডাটা) সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বর্ণিত সকল স্থানের Wind Mapping কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে।

NREL প্রদত্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা বিশেষত খুলনার দাকোপ, চট্টগ্রামের আনোয়ারা এবং চাঁদপুরের নদী মোহনার এলাকা সমূহে ১০০ মিটার উচ্চতায় বাতাসের গড়বেগ ৬ মিঃ/সেঃ এর বেশী যা বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনে অত্যন্ত সম্ভাবনাময়।

উক্ত প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলাদেশে প্রায় ২০,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা রয়েছে যেখানে বাতাসের বেগ ৫.৭৫-৭.৭৫ মিঃ/সেঃ যার মাধ্যমে প্রায় ৩০,০০০ মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। যদিও এই পরিসংখ্যান অনেকগুলো নিয়ামকের উপর নির্ভরশীল তবুও প্রতিবেদনটি বাংলাদেশে বায়ু বিদ্যুতের প্রসারে যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক।

লেখক: নাজমুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ইবাংলা/জেএন /১৭ জুলাই,২০২২

Contact Us