সম্ভাবনা নাকি আশঙ্কা ! ভারত-বাংলাদেশ সেপা বাণিজ্য চুক্তি?
ইবাংলা প্রতিবেদন
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি বা সেপা নামে নতুন একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে দুই দেশ।
এ ব্যাপারে যৌথ সমীক্ষা শেষে প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে সরকারের কাছে। সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাব্য ভারত সফরে এ ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে চুক্তিটি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে।
আরও পড়ুন…তারেক কানেকশন : আওয়ামী লীগে ভর করে হাশেম রেজার অস্বাভাবিক উত্থান
বলা হচ্ছে, এ চুক্তি বাস্তবায়ন হলে, কয়েক বছরের মধ্যেই ভারতে বাংলাদেশের রফতানি আয় ৩শ থেকে ৫শ কোটি ডলার পর্যন্ত বাড়বে। একই সময়ে ভারতের রফতানি আয় বাড়বে ৪শ’ থেকে এক হাজার কোটি ডলার।
আবার একই সঙ্গে এ চুক্তির কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি আরও বেড়ে যাওয়ারও আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। পাশাপাশি শঙ্কা রয়েছে মুক্ত বাণিজ্যের আওতায় ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বাণিজ্য সক্ষমতায় বাংলাদেশি পণ্য ও উৎপাদনকারীদের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার বিষয়টিও।
তবে স্বল্পোন্নত বা এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর কাতার থেকে বেরিয়ে আসায় ভবিষ্যতে বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে অচিরেই বাংলাদেশকে এ ধরনের বাণিজ্য চুক্তিতে যেতে হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। সে পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সঙ্গে সেপা চুক্তি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
আরও পড়ুন…প্রধানমন্ত্রী চা শ্রমিকদের কথা শুনবেন
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, সেবা এবং বিনিয়োগসহ নানা খাতে অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য হওয়া চুক্তিকে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনোমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট বা সংক্ষেপে সেপা বলা হচ্ছে। সেপাকে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি বা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট হিসেবেও ধরা যায়।
তবে সেপার ব্যাপ্তি সাধারণ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির থেকে অনেক বেশি। পণ্যের মুক্ত বাণিজ্যের পাশাপাশি, শুল্ক সহযোগিতা এবং মেধাস্বত্ব অধিকারের মতো বিষয়গুলোও সেপার আওতায় পড়ে।
সাধারণত কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয় সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি। চুক্তির প্রস্তুতি হিসেবে একটি যৌথ সমীক্ষা দল তৈরি করে সংশ্লিষ্ট পক্ষ। দুই দেশের বিদ্যমান ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতার নানা দিক নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করে এই সমীক্ষা দল।
আরও পড়ুন…গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সিকান্ডে আটক ঢাবি শিক্ষার্থীর জামিন
দুই দেশের মধ্যে হওয়া অন্যান্য বাণিজ্য চুক্তির সুবিধা, অসুবিধা ও দুর্বলতা চিহ্নিত করার পাশাপাশি দুই দেশের বাজার সক্ষমতার বিভিন্ন বিষয় নিয়েও গবেষণা চালায় তারা। পরবর্তী ধাপে সমীক্ষার পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে নানা আলোচনা ও সমঝোতা বৈঠকের মধ্যে দিয়ে চুক্তির শর্তগুলো প্রণয়ন করে দুই দেশ।
এ সব শর্তে সংযোজন, বিয়োজন, পরিমার্জন এবং সংশোধনের মধ্য দিয়ে একমত হওয়ার মাধ্যমে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের দিকে এগিয়ে যায় দুই দেশ। এরপর এই চুক্তির আইনগত নানা প্রক্রিয়া শুরু হয়।
সর্বশেষ ধাপে আইনগত প্রক্রিয়া শেষে চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর উভয় দেশের সংসদে এ বিষয়ে অনুমোদনের পর থেকেই মূলত কার্যকর হতে শুরু করে সেপা চুক্তি।
আরও পড়ুন…দেশের আট কোটির বেশি মানুষ আজীবন পেনশন পেতে পারেন
সাধারণ এফটিএ বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থেকে সেপা কিছুটা ভিন্ন। সেপার ব্যাপ্তি ও আকার সাধারণ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির থেকে অনেক বিস্তৃত। এর মধ্যে পণ্য ও সেবা বাণিজ্য, বিনিয়োগ, মেধাস্বত্ব ও ই-কমার্সের মতো অনেকগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। সাধারণত যেসব পণ্যের অবাধ বাণিজ্যের ব্যাপারে দুই দেশের সম্মতি থাকে সেই বিষয়গুলোতে হওয়া চুক্তিকে এফটিএ বলে।
আর দুই দেশের মধ্যে প্রায় সব ধরনের পণ্যের মুক্ত বাণিজ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক বাণিজ্যিক অংশীদারিত্বকে সেপা বলা হয়। তাই বলা যায়, সেপা সাধারণ কোন বাণিজ্য চুক্তি নয়, কারণ এর মধ্য দিয়ে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির পাশাপাশি আরও বৃহৎ পরিসরে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে
সহযোগিতার দ্বার উন্মুক্ত হয়।সাধারণত ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সহযোগী দেশগুলোর মধ্যেই হয় সেপা চুক্তি। তবে বাণিজ্য পরিস্থিতি, পণ্যের ধরন, বাণিজ্যিক আইন কানুন ইত্যাদি দেশভেদে বিভিন্ন হওয়ায় একেক দেশের ক্ষেত্রে সেপা চুক্তি একেক রকম হয়।
আরও পড়ুন…‘টপ পারফর্মিং’ ব্যাংকিং অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছে ইসলামী ব্যাংক
সাধারণত সেপা চুক্তি ‘উইন উইন উইন’ এই তিন বিবেচনায় করা হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে শুধু সংশ্লিষ্ট দুই দেশের সরকার ও ব্যবসায়ীদের সুবিধার কথাই মাথা রাখা হয় না, একই সঙ্গে ভোক্তাদের সুবিধার কথাও মাথায় রাখতে হয়। সেপার উদ্দেশ্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সাপেক্ষে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।
তবে মূল বিষয়টি হলো দুই দেশের মধ্যে পণ্য ও সেবার বিনিময়ের ক্ষেত্রটি আরও উদার এবং বহুমাত্রিক করা। পাশাপাশি পারস্পরিক বিনিয়োগ সম্ভাবনা বৃদ্ধির মাধ্যমে দুই দেশের বিনিয়োগের সামর্থ্য এবং বিনিয়োগ কার্যক্রম বৃদ্ধি করাও সেপার অন্যতম উদ্দেশ্য।
বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে সেপা চুক্তি রয়েছে ভারতের। আর কানাডা ও বাংলাদেশের সাথে সেপা চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলমান। বাংলাদেশ এখনও কারও সাথে সেপা চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। ধারণা করা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গেই প্রথম স্বাক্ষরিত হবে এই চুক্তি।
আরও পড়ুন…জবিতে এমফিল এবং পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি
এই চুক্তির পথ ধরে জাপান, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথেও সেপা চুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশেই কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট বা সেপা আছে। ইইউ দেশগুলোর মধ্যেও এই চুক্তি রয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতে দুই দেশই আছে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সাফটার আওতায়। এর অধীনে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে ভারতের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। কয়েক বছর পর বাংলাদেশ যখন উন্নয়শীল দেশের কাতারে যাবে, তখন আর সাফটার বিদ্যমান সুবিধা পাবে না।
তখন দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা ও বাণিজ্য বাড়াতে নতুন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রয়োজন হবে। তাছাড়া ভারত বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য সহযোগী। চীনের পরই সবচেয়ে বেশি পণ্য ভারত থেকে আমদানি করে বাংলাদেশ। তবে রফতানি সে তুলনায় নগণ্য। উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতিও অনেক বেশি।
আরও পড়ুন…শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বেই দেশে অভাবনীয় উন্নয়ন
যা প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ভারত থেকে ১ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করলেও রফতানি করেছে মাত্র ২শ’ কোটি ডলারের পণ্য। ভারত তাদের বাজারে বাংলাদেশের অধিকাংশ পণ্যেই শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলেও নন-ট্যারিফ বাধার কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের রফতানি প্রত্যাশিতভাবে বাড়ছে না।
সে হিসেবে দেশটির বিশাল বাজার ধরতে সেপা চুক্তি সহায়ক হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।সেপা চুক্তি স্বাক্ষর হলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশ উল্লেখযোগ্য কিছু সুবিধা পাবে, কিন্তু এর বেশ কিছু সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জও আছে।
যদি ভারতের পণ্য বাংলাদেশি বাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধা পায় সেক্ষেত্রে ভারতীয় বৃহৎ কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়বে স্থানীয় শিল্পের। কারণ ভারতীয় শিল্প কাঁচামালের দিক থেকে অনেকাংশেই স্বাবলম্বী পক্ষান্তরে বাংলাদেশকে অধিকাংশ শিল্প কাঁচামালই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
আরও পড়ুন…নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ
এ পরিস্থিতিতে উৎপাদন খরচে দেশের বাজারে ভারতীয় পণ্যের সাথে অসম প্রতিযোগিতায় পড়তে পারে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে বর্তমানে বৃহৎ পুঁজি বা কর্পোরেট বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর জয়জয়কার। দেশটির কনজ্যুমার মার্কেট বা ভোক্তা বাজারে বড় কর্পোরেট কোম্পানির দাপটে দেশটির ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোই অনেকটা অসহায়।
সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের বাজারে মুক্ত বাণিজ্যের সুবিধা পেলে ভারতীয় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর দাপটে স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হুমকির মুখে পড়তে পারে। সেপা স্বাক্ষরের সময় এই বিষয়টিতে নজর দিতে হবে। এ জন্য সেপা চুক্তি যেন উভয়পক্ষের জন্য উইন উইন হয় সে বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি প্রয়োজন বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।
সেপা চুক্তিতে কাগজে কলমে শর্তাবলী উভয় দেশের জন্যই সমান সমান অর্থাৎ উইন উইন হলেও বাস্তবে ফারাক তৈরি করতে পারে চুক্তি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট পক্ষের ব্যবস্থাপনার দক্ষতার বিষয়টি।
আরও পড়ুন…পাবনায় সুজন হত্যার বিচার দাবীতে নোয়াখালীতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ
চুক্তির সুফল পেতে হলে বন্দর ও শুল্ক ব্যবস্থাপনা সহ সংশ্লিষ্ট সব সরকারি প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট এফিসিয়েন্সির বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। নয়তো কাগজে কলমে থাকলেও চুক্তির সুবিধা পুরোপুরি পেতে ব্যর্থ হবে বাংলাদেশ।
ইবাংলা/তরা/৩১ আগস্ট ২০২২
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.