হিমাগারের ২৪ লাখ টন আলুর কী হবে

ডেস্ক রিপোর্ট

দেশের বিভিন্ন এলাকায় হিমাগারগুলোতে শেডভর্তি আলু পড়ে আছে। এতে সংরক্ষিত ২৪ লাখ টন আলু দুই মাসের মধ্যে বাজারজাত করতে না পারলে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা লোকসান হতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্নিষ্ট কৃষক, ব্যবসায়ী ও হিমাগার মালিকদের। এ অবস্থায় ত্রাণ হিসেবে আলুর ব্যবহার বাড়াতে বিভিন্ন দপ্তরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরও মিলছে না সুফল।

Islami Bank

লোকসান কমাতে আলুর ব্যবহার বাড়ানো ও রপ্তানিতে গুরুত্ব দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। শিল্পে এর ব্যবহার ও রপ্তানিযোগ্য আলু চাষে চার বছর মেয়াদি রোডম্যাপও চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে এ মন্ত্রণালয়। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, দেশে আলুর চাহিদা ৯০ লাখ টন, কিন্তু গত মৌসুমে পরিবেশ অনুকূলে থাকায় উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ১৪ লাখ টন।

সে হিসাবে আলু উদ্বৃত্ত থাকছে ২৪ লাখ টন। উৎপাদিত আলু থেকে দেশের ৪০০ হিমাগারে ৪০ লাখ টন আলু সংরক্ষণ করা হয়েছিল। করোনায় হোটেলসহ সব কিছু বন্ধ থাকায় ৬৫ শতাংশ আলুই বিক্রি হয়নি। এখন খরচের তুলনায় বাজারে দাম কম থাকায় অনেক কৃষক ও ব্যবসায়ী হিমাগার থেকে আলু তুলছেন না। অথচ আলুর নতুন মৌসুম শুরু হতে বাকি আর মাত্র দুই মাস। ফলে বিক্রি শেষ না হলে লোকসানের সঙ্গে নতুন আলু সংরক্ষণ নিয়েও জটিলতা তৈরি হবে।

কৃষক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিবছর দেশে আলু উৎপাদন ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে বাড়লেও এর বহুমুখী ব্যবহারে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া কিছু দেশে আলু রপ্তানি করা হলেও আলুর জাত ও গুণগত মানের কারণে সেই বাজারও ধরে রাখা যায়নি।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোশারফ হোসেন জানান, চলতি মৌসুমের আলু বাজারজাতকরণের আর মাত্র দুই মাস বাকি। এর মধ্যে সংরক্ষিত আলু বাজারজাত না হলে বিপুল পরিমাণ অবিক্রীত থাকবে। সেগুলো ফেলে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

তিনি বলেন, টিসিবির ডিলার ও ওএমএস কার্যক্রমে আলু বিক্রি জোরদার করা হোক। আলু রপ্তানিতে পাঁচ হাজার টন ধারণ ক্ষমতার একটি রেফার ভেসেল (পচনশীল দ্রব্য পরিবহনের উপযোগী শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত জাহাজ) সরকারিভাবে কেনার দাবি জানান তিনি।

এ ধরনের জাহাজ কেনা হলে আলু দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখা যাবে। এ ছাড়া রপ্তানি উপযোগী আলু উৎপাদনে উন্নত বীজ, মাটিজাত রোগবালাই দূরীকরণে বিশেষ ব্যবস্থা নিতেও বলেন তিনি। আলু থেকে তৈরি নতুন নতুন সুস্বাদু খাবার জনপ্রিয় করার জন্য উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে মেলা আয়োজনের দাবি জানান মোশারফ হোসেন।

আলু সংরক্ষণের হিমাগারের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের বিদ্যুৎ বিল স্থগিত রেখে তা পরে সারচার্জ ছাড়া পরিশোধের সুযোগ চান ব্যবসায়ীরা। চালের ওপর চাপ কমাতে আইনশৃঙ্খলা ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর আবাসিক হলে আলু খাওয়ানো বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাবও দেন তারা।

সরকার আলু উৎপাদনে ৮০০ কোটি টাকা সারের ওপর ভর্তুকি দিয়ে থাকে। সেই সারে আলুর বাম্পার ফলন হচ্ছে। কিন্তু আলুর বাজার তৈরি না হওয়ায় বছর বছর লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষককে। কৃষক ও হিমাগারের মালিকরা জানান, উৎপাদন ও হিমাগারের ভাড়াসহ প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) আলুর জন্য চাষির খরচ হয় ৮৫০ টাকা।

বর্তমানে পাইকারি বাজারে সে আলুর দাম ৪০০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজি আলুর দাম মাত্র ৮ টাকা। গত এক সপ্তাহে রাজধানীর খুচরা বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে।

one pherma

আলু তোলার মৌসুমের সময় প্রতি কেজির দাম ছিল ১৩ থেকে ১৪ টাকা। অনেকেই বেশি দামের আশায় তখন বিক্রি না করে আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করেন। গত বছর এই সময়ে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা আলু এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন চাষিরা।

এদিকে, অনেক চাষিই আলু রেখে হিমাগার মালিকদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। আলু নিতে চাইলে এখন সে ঋণও শোধ করতে হবে। রংপুরের তারাগঞ্জের এন এন হিমাগারের ব্যবস্থাপক ডালিম মিয়া বলেন, তার হিমাগারে এখনও পড়ে আছে এক লাখ ৪৬ হাজার বস্তা আলু। প্রতি বস্তার বিপরীতে চাষিদের ঋণ দেওয়া হয় ২৫০ টাকা করে।

হিমাগার থেকে আলু বের করতে এখন অনীহা দেখাচ্ছেন ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, গত ১০ বছরের মধ্যে ছয় বছরই তারা আলুতে লোকসান দিয়েছেন। একই অবস্থা কুড়িগ্রাম, বগুড়া, জয়পুরহাট, খুলনা, মুন্সীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার।

সরকারের উদ্যোগ: উদ্বৃত্ত আলু সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য গত মে মাস থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, টিসিবি, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরসহ সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় বৈঠক করে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর আলুর বাজার স্থিতিশীল এবং এর সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে মতামত পাঠায়। এ অবস্থায় ত্রাণ কার্যক্রমে আলুর ব্যবহার বাড়াতে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেয় কৃষি মন্ত্রণালয়।

সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয় রপ্তানি উপযোগী ১৮টি আলুর উন্নতজাতের নিবন্ধন দিয়েছে। এ ছাড়া সংকট দূর করতে ২০২৫ সাল নাগাদ আড়াই লাখ টন আলু রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে খসড়া রোডম্যাপ প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি)। রোডম্যাপে বাংলাদেশের আলু রপ্তানি পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এক লাখ দুই হাজার টন আলু রপ্তানি হয়। সেটি কমতে কমতে সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে মাত্র ৫৬ হাজার টনে নেমেছে।

আলু রপ্তানির চ্যালেঞ্জ হিসেবে বলা হয়, দেশে রপ্তানি উপযোগী, শিল্পে ব্যবহার এবং রোগমুক্ত জাতের বীজের অভাব রয়েছে। নিম্নমানের আলু রপ্তানির ফলে রপ্তানি কমে গেছে। এ ছাড়া যথোপযুক্ত প্রত্যয়ন ও অ্যাক্রিডিটেড ল্যাবের অভাব, পরিবহন সমস্যা, আলু রপ্তানিতে উচ্চহারে ভ্যাট ও ট্যাক্স আদায় এবং কুলিং চেম্বার, কোল্ড স্টোরেজ, কুলিং ভ্যানের অপ্রতুলতা রয়েছে।

রপ্তানি কর্মকাণ্ড সমন্বয় ও গতিশীল করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি কমিটি করার কথা বলা হয়েছে রোডম্যাপে। এ ছাড়া রপ্তানি বাজার অনুসন্ধান, জাত ছাড়করণ, বীজ উৎপাদন, রপ্তানিযোগ্য আলু উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও প্রেরণ, প্রত্যয়ন এবং পরিবহন ও জাহাজীকরণে উপকমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে রোডম্যাপের খসড়ায়।

এসব সমস্যার সমাধান হলে ২০২২ সালে ৮০ হাজার টন, ২০২৩ সালে এক লাখ ২০ হাজার টন, ২০২৪ সালে এক লাখ ৮০ হাজার এবং ২০২৫ সালে দুই লাখ ৫০ হাজার টন আলু রপ্তানি করা সম্ভব বলে রোডম্যাপে উল্লেখ করা হয়েছে।

কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আলুর সুষ্ঠু বাজারজাতে স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি রপ্তানি বাড়াতে হবে। এ নিয়ে প্রচেষ্টা চলছে। আগামীতে আলুর রপ্তানি অনেক বাড়বে। ভালো জাতের অভাবে এতদিন আলু রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সমস্যা হতো। ইতোমধ্যে বিদেশ থেকে অনেকগুলো উন্নত জাত আনা হয়েছে। জাত নিয়ে আর সমস্যা থাকবে না।

Contact Us