দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাস করছে প্রায় ১৫ হাজার বিদেশি নাগরিক। এদের মধ্যে ৫ হাজার নাগরিকের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগই বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরাও পড়েছেন। এরপর তারা জামিন নিয়ে আবারও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। বেশ কয়েকজন নাগরিক আবার জামিন নিয়ে গোপনে নিজ দেশে চলেও গেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এসব বিদেশিরা এদেশে এসেই পাসপোর্ট নষ্ট করে ফেলে। ঢাকায় ওইসব দেশের দূতাবাস নেই বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদেরকে সহায়তা করতে পারেনা। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে ওই সব দেশের অপরাধীরা বছরের পর বছর ধরে ঢাকায় অবস্থান করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যায়। রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি, নিকুঞ্জ, বনশ্রীসহ অভিজাত এলাকায় এরা বাড়িভাড়া অথবা হোটেল ভাড়া নিয়ে অবস্থান করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নাইজেরিয়া, ঘানা, সেনেগাল. ক্যামেরুন, লাইবেরিয়া, কেনিয়া, চাঁদসহ আফ্রিকার ১০ টি দেশের ৫ হাজার নাগরিক অবৈধভাবে বসবাস করে বছরের পর বছর ধরে ভয়ঙ্কর প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি কয়েক হাজার অবৈধ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, চীন ও তাইওয়ান নাগরিকের বিরুদ্ধেও রয়েছে একই ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ। বিদেশিদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয়গুলোর কোনো সমন্বিত কোনো উদ্যোগ নেই। পুলিশ ও র্যাব এদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোর পর নানাবিধ সমস্যার কারণে সরকার এদেরকে নিজ দেশে ফেরাতেও পারছে না।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (ডিবি) কর্মকর্তারা জানান, গ্রেফতারকৃত আফ্রিকানদের সম্পর্কে তদন্ত করতে গিয়েও নানা ঝামেলা পোহাতে হয়। কারণ গ্রেফতারকৃত অধিকাংশ আফ্রিকান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তাদের পাসপোর্ট বা বাংলাদেশে প্রবেশের বৈধ কোনো কাগজপত্রের হদিস মেলে না।
ফলে তাদের নাম-ঠিকানা যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে গ্রেফতারের পর তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিটও দেওয়া যায় না। দুই বছর আগে ঢাকায় ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির অভিযোগে পান্থপথের একটি হোটেল থেকে ডিবি ৬ ইউক্রেনীয় নাগরিককে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে তারা জামিন নিয়ে গোপনে নিজ দেশে চলে যায়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপকমিশনার (লালবাগ) মশিউর রহমান বলেন, এসব বিদেশির ভিসার মেয়াদ শেষ হলে পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে। রাজধানীতে বেশ কিছু লোভী বাড়ির মালিক অথবা হোটেল মালিক টাকার লোভে তাদেরকে থাকতে দেয়।
এক্ষেত্রে ওইসব বিদেশীর পাসপোর্ট বা পরিচয় সংক্রান্ত কোনো তথ্যই সংশ্লিষ্ট থানায় পাঠায় না। অপরাধী হিসাবে তাদের গ্রেফতার করার পর জামিনে বেরিয়ে গা-ঢাকা দেয়। তাদের শনাক্ত করার পাশাপাশি ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে কী করণীয়, তা নির্ধারণে দুই বছর আগে সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি দেয়া হয়েছে।
অনলাইনে প্রতারণা, বিনিয়োগে কোটিপতির স্বপ্ন, এটিএম কার্ড জালিয়াতি, জাল মুদ্রা, হুন্ডি, মাদক কারবার, মুদ্রা পাচার ও সোনা চোরাচালান এমনকি ছিনতাইসহ যাবতীয় অপকর্মে জড়িত এসব অবৈধ বিদেশি নাগরিকরা। টুরিস্ট, খেলোয়াড়, বিজনেস কিংবা স্টুডেন্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ফিরে না গিয়ে অবৈধভাবে বসবাস করছে।
গত তিন বছরে দুই শতাধিক বিদেশি অপরাধীকে গ্রেফতার করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাংলাদেশে ফেসবুকে উপহার পাঠানোর নামে প্রতারণা, হেরোইন, কোকেন ও অপ্রচলিত মাদকের কারবার, ব্যাংকের এটিএম বুথে জালিয়াতি, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি, জাল ডলার কারবার, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, সোনা চোরাচালান, অনলাইনে ক্যাসিনো এবং মানবপাচারে জড়িত থাকার অপরাধে এদের গ্রেফতার করা হয়।
গত বছরের নভেম্বর মাসে শুরুতে উত্তরা থেকে গ্রেফতার করা হয় ক্যামেরুনের চার অবৈধ নাগরিকসহ ছয়জনকে। তারা মাদক কারবার ও অনলাইনে প্রতারণায় জড়িত। আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকার কথাও স্বীকার করে বিদেশি এই অপরাধীরা। গত ২৭ আগস্ট বারিধারা ও কাওলা থেকে সিসম, মরো মহাম্মদ, মরিসন, অ্যান্থনি নামে নাইজেরিয়া ও ঘানার চার নাগরিককে গ্রেফতার করে সিআইডি। গত ২১ জুলাই পল্লবী থেকে বাংলাদেশি নারীসহ ১২ নাইজেরিয়ানকে গ্রেফতার করে সিআইডি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিবির উপকমিশনার (লালবাগ) মশিউর রহমান বলেন, এসব বিদেশি চক্র ঢাকায় বসে ফেসবুক ব্যবহার করে এজেন্টের মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদ পাতে। প্রথমে তারা ফেসবুকে আইডি খুলে বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। ই-মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারেও তারা বন্ধুত্ব গড়ে। একপর্যায়ে তারা মোটা অঙ্কের টাকার লোভ দেখায়। ইন্টারনেট ও মোবাইলে লোভনীয় লটারি পাওয়ার মেসেজ পাঠিয়ে মূল্যবান গিফট পাঠানোর কথা বলে পার্সেল ফি আদায় করে প্রতারণা চালায়।
পুলিশের বিশেষ শাখার (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) সূত্র জানায়, এ দেশে অবৈধ বা বৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশি প্রতারক চক্রের প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতারের পর বিদেশি নাগরিকের ডাটাবেজ তৈরির কাজ চলছে। গত চার মাসে প্রায় এক হাজার বিদেশির ওপর অনুসন্ধান ও নজরদারি করা হয়।
দেশে প্রায় দুই লাখ বিদেশি অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে ১৭ হাজার আফ্রিকানসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক রয়েছে, যারা দেশের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এদের মধ্যে বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসকারী ১৫ হাজার বিদেশিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই ১৫ হাজার অবৈধ বিদেশির মধ্যে ৫ হাজার বিদেশি নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত।
এমন পরিস্থিতিতে অন্তত ১০টি দেশের কয়েক হাজার অপরাধীর তালিকা তৈরি করে অভিযান শুরু করা হয়েছে। একই সঙ্গে অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের অপরাধ করার সঙ্গে সহায়তাকারী দেশীয় অপরাধী চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধেও অভিযানে নেমেছে পুলিশ, র্যাব, সিআইডি, এসবি।
আরও পড়ুন…বিচারকের সঙ্গে অশালীন আচরণের ঘটনায়, বিজেএস ফোরামের নিন্দা
এছাড়া অবৈধ বিদেশিদের কাছে বাড়ি ভাড়া দিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে পুলিশ। বিদেশিদের কাছে বাসা ভাড়া দেয়ার সময় বাড়ির মালিককে অবশ্যই তার পরিচয় নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রাখতে হবে। একই সঙ্গে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকেও অবহিত করতে হবে।
ইবাংলা/জেএন/৬ জানুয়ারি, ২০২৩
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.