বাল্যবিবাহের প্রচলনে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ অবস্থানে বাংলাদেশ। এমনকি পুরো বিশ্বের মধ্যে এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান আট নম্বরে। বুধবার (৩ মে) বাল্যবিয়ে নিয়ে ইউনিসেফের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। ২০১৯ সালের বাংলাদেশ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভের তথ্য ব্যবহার করে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সবমিলিয়ে দেশের শতকরা ৫১ শতাংশ তরুণীর বিয়ে হয়েছে তাদের শৈশবে। এরমধ্যে ৩ কোটি ৪৫ লাখ তরুণীর বিয়ে হয়েছে বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই এবং ১ কোটি ৩ লাখ তরণীর বিয়ে হয় ১৫ বছর হওয়ার আগে।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে শিশুবিয়ের প্রচলন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি এবং বিশ্বের মধ্যে অষ্টম সর্বোচ্চ।
আরও পড়ুন>> বৃহস্পতিবার সীমিত পরিসরে খোলা থাকবে ব্যাংক
এ বিষয়ে বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, ‘শিশুদের বিয়ে দেওয়া উচিত নয়। অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে শিশুবধূর সংখ্যা বিস্ময়কর। লাখ লাখ মেয়ের শৈশব কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এবং তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। মেয়েরা যাতে স্কুলে যেতে পারে তা নিশ্চিত করতে এবং তারা যাতে পরিপূর্ণভাবে নিজের মাঝে থাকা সম্ভাবনা অনুযায়ী বেড়ে উঠতে পারে- সে সুযোগ দিতে সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার।’
শেলডন ইয়েট বলেন, যেসব মেয়ের শৈশবে বিয়ে হয়ে যায় তাদের তাৎক্ষণিক এবং জীবনভর এর পরিণতি ভোগ করতে হয়। তাদের স্কুলে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভাবনা খুবই কম থাকে এবং তারা অল্প বয়সে গর্ভধারণের বাড়তি ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। ফলে তা শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের জটিলতা ও মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়। শিশুবিয়ের এই প্রচলন মেয়েদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধব থেকেও বিচ্ছিন্ন করতে পারে এবং তাদের নিজেদের কমিউনিটিতে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত রাখতে পারে। যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও সার্বিক কল্যাণের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
প্রতিবেদনে সর্বশেষ বৈশ্বিক হিসাব তুলে ধরে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী আজ জীবিত প্রায় ৬৪ কোটি মেয়ে ও নারীর বিয়ে হয়েছে তাদের ছোটবেলায়। এছাড়া বর্তমানে প্রতি বছর ১ কোটি ২০ লাখ মেয়ের বিয়ে হয় তাদের ছোটবেলায়। পাঁচ বছর আগে এ বিষয়ে সর্বশেষ হিসাব প্রকাশের পর, এ পর্যন্ত ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে যাওয়া তরুণীর সংখ্যা ২১ শতাংশ থেকে ১৯ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে এই অগ্রগতি সত্ত্বেও ২০৩০ সালের মধ্যে শিশুবিয়ের অবসান করার যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা পূরণের জন্য বিশ্বব্যাপী ওই কমার গতি ২০ গুণ দ্রুততর হতে হবে।
আরও পড়ুন>> ইউক্রেন গোয়েন্দা সংস্থার ৭ জনকে আটক করেছে রাশিয়া
এতে আরও বলা হয়, অগ্রগতি সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ায় এখনও প্রতি চারজন তরুণীর মধ্যে একজনের বিয়ে হচ্ছে তার ১৮তম জন্মদিনের আগেই। অঞ্চলটি বাল্য বিবাহে সর্বোচ্চ অবস্থায় রয়েছে। শিশু বধূর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে সাব-সাহারান আফ্রিকার অবস্থান দ্বিতীয় (২০ শতাংশ)। পাশাপাশি শিশুবিয়ে নির্মূলের ক্ষেত্রে ধীরগতি সবচেয়ে বেশি সাব-সাহারান আফ্রিকায়। ওই অঞ্চলে শিশুবিয়ের অবসানে ২০০ বছরেরও বেশি সময় লাগবে। সেই সঙ্গে চলমান সংকটের পাশাপাশি দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি বিশ্বের বাকি অংশে প্রত্যাশিত হ্রাসের বিপরীতে এই অঞ্চলে শিশু বধূর সংখ্যা বাড়িয়ে দেবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এই খাতে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলও পিছিয়ে পড়ছে। সেখানে বর্তমানের ধারা অব্যাহত থাকলে অঞ্চলভেদে শিশুবিয়ের দিক থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম অঞ্চলে পরিণত হবে। ক্রমাগত অগ্রগতির পর মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়াতেও অগ্রগতি স্থবির হয়ে পড়েছে।
এর কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজুড়ে সংঘাত, জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপর্যয় এবং কোভিড-১৯ এর চলমান প্রভাবসমূহ, বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য, আয়-রোজগারে ধাক্কা এবং স্কুল থেকে ঝরে পড়ার ঘটনা শিশুবিয়ের চালিকাশক্তিগুলোকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করছে। একই সঙ্গে মেয়েদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সামাজিক সেবা ও কমিউনিটির সমর্থন পাওয়াকে কঠিন করে তুলছে, যা তাদের শিশুবিয়ে থেকে রক্ষা করে। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করা মেয়েদের শিশু বিয়ে হওয়ার ঝুঁকি বৈশ্বিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়াও সংঘাতজনিত মৃত্যুর প্রতি দশগুণ বৃদ্ধির জন্য শিশুবিয়ের হার ৭ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। একই সময়ে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত চরম আবহাওয়াজনিত ঘটনাগুলো মেয়েদের ঝুঁকি বাড়ায় এবং বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে প্রতি ১০ শতাংশ বিচ্যুতি শিশুবিয়ের প্রকোপ প্রায় ১ শতাংশ বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়, কোভিড-১৯ এর চলমান প্রভাবসমূহের কারণে বিগত এক দশকে শিশুবিয়ের অবসান ঘটাতে মূল্যবান অর্জনগুলোও হুমকির সম্মুখীন। এমনকি তা আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, মহামারিটি ইতোমধ্যে শিশুবিয়ে প্রতিহতের সংখ্যা ২০২০ সাল থেকে এক-চতুর্থাংশ কমিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন>> বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসায় বিশ্বব্যাংক
এ বিষয়ে ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেন, ‘বিশ্ব একের পর সংকটে জর্জরিত। যা ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের আশা ও স্বপ্নকে চুরমার করে দিচ্ছে, বিশেষ করে মেয়েদের। যাদের বিয়ের কনে হিসেবে নয় বরং শিক্ষার্থী হিসেবে থাকা উচিত। স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকট, ক্রমবর্ধমান সশস্ত্র সংঘাত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব পরিবারগুলোকে শিশুবিয়ের মতো মিথ্যা ধারণার আশ্রয় নিতে বাধ্য করছে। শিশুদের পড়াশোনার করার ও সক্ষম জীবনের অধিকারী হওয়ার অধিকার যাতে সুরক্ষিত হয় তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের সাধ্য অনুযায়ী সবকিছু করতে হবে।’
ক্যাথরিন রাসেল বলেন, ‘আমরা প্রমাণ করেছি যে শিশুবিয়ের অবসানে অগ্রগতি সম্ভব। তবে এর জন্য শিশুবিয়ের ঝুঁকিতে থাকা মেয়ে ও পরিবারগুলোর জোরালো সমর্থন প্রয়োজন। মেয়েদের স্কুলে টিকিয়ে রাখার বিষয়ে এবং তাদের অর্থনৈতিক সুযোগ নিশ্চিত করার দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।’
ইবাংলা/এসআরএস
মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়েছে.