দেশের উন্নয়ণ প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয় বাড়ছে । প্রকল্পের নির্ধারিত সময়ের দ্বিগুন সময় বাড়ছে, ফলে প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে। ৩৬ কোটি টাকার ‘জিইওইউপিএসি প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয় ১৩ কোটি ৫৬ লাখ । মূল টিএপিপিতে (কারিগরি প্রকল্প প্রস্তাব) কনসালটেন্সি (পরামর্শক) বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এখন সংশোধনী প্রস্তাবে সেটি বাড়িয়ে করা হচ্ছে ১৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকায়। বর্ধিত ৩ কোটি ৯৬ লাখ টাকা অতিরিক্ত ধরা হয়েছে। এ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
‘জিও-ইনফরমেশন ফর আরবান প্লানিং অ্যান্ড এডাপটেশন টু ক্লাইমেট চেঞ্জ (জিইওইউপিএসি)’ শীর্ষক প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাবে এমন বর্ধিত ব্যয় ধরা হয়েছে। প্রস্তাবটি নিয়ে বিশেষ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (এসপিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করেন পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সচিব) শরিফা বেগম।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব এবং ভূ-দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য প্রকল্প এলাকার ভূ-বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্ত প্রস্তুত, একত্র ও উপযোগী করা। নগর পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় যথাযথভাবে ভূ-বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্তের ব্যবহার, মান, বৈচিত্র এবং কর্মপরিধি বৃদ্ধি করা; নগর ভূ-প্রকৌশল এবং ভূ-বিজ্ঞানের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অধিকতর নিয়ন্ত্রক ক্ষমতা এবং সেবা দেওয়ার সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য জিএসবির কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনাকালে ৫ জন পরামর্শক এদেশে আটকা পরা ছিল। তারা দেশে ফিরে যেতে না পারায় তাদের পিছনে কিছু টাকা খরচ হয়েছে। এছাড়া সংশোধিত প্রস্তাবে পরামর্শকদের অতিরিক্ত কাজ যুক্ত করা হয়েছে। শরিফা বলেন, আমরা যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে আনতে বলেছি।
জানা গেছে, জার্মান সরকারের অনুদানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পিইসি সভা কার্যপত্রে বলা হয়েছে, সংশোধনী প্রস্তাবে ফ্যাক্স, ইন্টারনেট, শ্রমিক মজুরি এবং যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সরঞ্জাম বাবদ ২ কোটি ৬৫ লাখ টাকার বিপরীতে সংশোধিত প্রস্তাবে ২ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা ধরা হয়েছে। অর্থাৎ মোট ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে। সভায় এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা এবং বৈদেশিক সাহায্যে থেকে ৩৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। সংশাধনী প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলে ২০২২ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন শেষ করবে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর (জিএসবি)।
প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে, জিও টেশনিক্যাল ড্রিলিং এবং অন্যান্য বিষয়ে ৩৫০টি সার্ভে সম্পাদন, বিভিন্ন ধরনের মানচিত্র প্রণয়ন ও প্রকাশ, ৮৩০ জনের স্থানীয় প্রশিক্ষণ এবং ১৯ জনের বৈদেশিক প্রশিক্ষণ, ৬ আইটেমের কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক ক্রয়, ৩৭টি সফটওয়্যার ক্রয় এবং ১০টি এয়ার কন্ডিশনার ক্রয় ও স্থাপন করা হবে।
ত্রিমাত্রিক ভূ-তাত্ত্বিক ও ভূ-বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব, ভূপৃষ্ঠ এবং ভূতলের পানির লবণাক্তা বৃদ্ধি, ভূ-প্রাকৃতিক বিন্যাসের পরিবর্তন, জলাবদ্ধতা, উপকূলীয় এলাকায় সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত প্রভাব, ঘূর্ণিঝড় জোয়ারজনিত ক্ষয় ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা গেলে তা অধিকতর টেকসই, নিরাপদ ও দুর্যোগ প্রশমিত হবে।
এছাড়া অবকাঠামোগত স্থাপনার নির্মাণ ব্যয় ও ঝুঁকির হ্রাস পাবে। জিও বৈজ্ঞানিক সারফেস এবং সাব-সারফেস এলাকা ভিত্তিক অনুসন্ধানমূলক এই কারিগরি সহায়তা প্রকল্প হতে পাওয়া তথ্য নগর পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট পেশাদার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের টেকসই, নিরাপদ, কম ঝুঁকিপূর্ণ নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নে সহায়তা করবে।
সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকল্পটি অনুমোদনের আদেশ জারি করা হয়। প্রকল্পের প্রাক্কলিত মোট ব্যয় ৩৬ কোটি টাকা এবং মেয়াদ ২০১৮ সালের জানুয়ারি হতে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রাক্কলিত ব্যয়ের মধ্যে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা সরকারি যা কর্মকর্তাদের বেতন ও আনুষঙ্গিক বাবদ ব্যয় করা হবে। বাকি ৩৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা প্রকল্প ঋণ।
প্রকল্প সাহায্যে সম্পূর্ণ অর্থ ডিপিএ (ডাইরেক্ট প্রজেক্ট এইড) খাতে রয়েছে এবং তা উন্নয়ন সহযোগীর মাধ্যমে ব্যয় করা হচ্ছে। প্রকল্পটির কাজ শেষ করতে ব্যয় ছাড়া সময় বৃদ্ধি এবং কিছু অঙ্গের ব্যয় পরিবর্তনের জন্য জ্বালানি বিভাগ থেকে টিএপিপি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রকল্প সংশোধনের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, কোভিডের প্রভাব। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে জার্মান বিশেষজ্ঞরা ২০২০ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করায় এবং প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে দেরি হওয়ায় ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে কাজের অগ্রগতিও কম হয়।
অনুমোদিত টিএপিপি মোতাবেক প্রকল্পের জিএসবির কর্মকর্তাদের জার্মানিতে কারিগরি প্রশিক্ষণ, স্থানীয় সেমিনার, ওয়ার্কশপসহ অন্যান্য কার্যক্রম নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করতে না পারায় ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভায় প্রকল্পের মেয়াদ একবছর ৬ মাস বৃদ্ধি করে ২০১৮ সালের জানুয়ারি হতে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের পরিবর্তে ২০১৮ সালের জানুয়ারি হতে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধিও সুপারিশ করা হয়।
প্রকল্পটি ২০১৮ সালে নেওয়া হয়েছে, পরবর্তীতে বাস্তবায়নকালে উদ্ভূত প্রয়োজনের নিরিখে বিভিন্ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ৬টি অঙ্গের বিপরীতে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ১৪টি অঙ্গের বিপরীতে ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। আরডিপিপিতে ব্যয় বেড়েছে রাজস্ব খাতে মোট ২ কোটি ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা তারমধ্যে ২০ লাখ টাকা সরকারি খাতের। আর মূলধন খাতে সমপরিমাণ অর্থাৎ ২ কোটি ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা ব্যয় কমেছে। এর জন্য সংশোধিত আরটিএপিপিতে প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় এবং বাস্তব অগ্রগতি (আরটিএপিপি) অনুযায়ী গত বছরের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় ২১ কোটি ৪১ লাখ টাকা (৬০ শতাংশ) এবং বাস্তব অগ্রগতি ৬০ শতাংশ। পুরো কাজ শেষ করতে মেয়াদ বাড়ানো প্রয়োজন। এসএপিইসি সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল ২০১৮ সালের জানুয়ারি হতে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্ধারিত ছিল।
সংশোধিত আরটিএপিপি বিলম্বে পাঠানোর কারণ সভায় আলোচনা করা যেতে পারেও মত দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারি খাতে ৪০০ বর্গ মিটার রুম স্পেসের ভাড়া মাসিক ২ লাখ টাকা বাবদ মোট ৯০ লাখ টাকা এবং মাসিক বিদ্যুৎ ৫০ হাজার টাকা বাবদ মোট ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা ও রুম স্পেস ভাড়া এবং মাসিক বিদ্যুৎ বরাদ্দের একক দরের যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করা হয়েছে।
মূল টিএপিপিতে ২৮টি (২২টি স্থানীয়, ৬ বৈদেশিক) প্রশিক্ষণ ব্যয়ের বিপরীতে ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকার সংস্থান দেখানো হয়েছে।তবে আরটিএপিপিতে আরও ৯টি স্থানীয় প্রশিক্ষণসহ মোট ৩৭টি প্রশিক্ষণের কথা উল্লেখ করে ৬৫ লাখ টাকা ব্যয় হ্রাস দেখানো হয়েছে।
ইবাংলা/ আমিন/ ০৬ নভেম্বর /২০২১