স্মৃতিতে শহীদ নূর হোসেন

কুদ্দুস আফ্রাদ, ঢাকা

আজ ১০ নভেম্বর। শহীদ নূর হোসেন দিবস । ১৯৮৭ সালের এ দিনে ৮ দল, ৭ দল ও ৫ দল ঢাকা অবরোধ আহবান করেছিল। প্রচন্ড শীত ছিল তার কয়েকদিন আগে থেকেই। এদিন দুপুরে নূর হোসেন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আমরা অনেকেই একসঙ্গে লড়াই করেছি এরশাদ স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে।

আমি সেসময় সবে সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছি, আবার জাতীয় ছাত্রলীগের একজন কর্মি হিসাবে আন্দোলনও করছিলাম এরশাদ শাহীর বিরুদ্ধে। নুর হোসেন নিহত হওয়ার পর, জাতীয় প্রেসক্লাবে সেদিন পুলিশী ঘেরাও-এর মুখে তদানীন্তন বাকশাল সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাককে (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতা ও পানি সম্পদ মন্ত্রী) সেদিন বিকালে মাথায় হেলমেট পড়িয়ে ও ‘সাংবাদিক’ স্টিকার লাগানো মটর সাইকেলে করে প্রেসক্লাব থেকে গোপণে ইনার সার্কুলার রোডে রেখে এসেছিলেন সে সময়ের জাতীয় ছাত্রলীগ নেতা ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু।

তার আগে এদিন রাজ্জাক ভাইয়ের অনুরোধে দুপুর ১২টার দিকে টিঙ্কু এবং আমি ৮ দলের পক্ষ থেকে তৈরী করা বিরোধী তিন জোটের যৌথ ঘোষণার খসড়া চিঠি নিয়ে গিয়েছিলাম ৭ দলের নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে হোটেল পূর্বাণীতে।

খালেদা জিয়া আগেরদিন রাতে গোপনে পূর্বানী হোটেলের একটি কক্ষে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে আমরা উপস্থিত হয়ে মজিদ উল হককে রাজ্জাক ভাইয়ের কথা জানালে খালেদা জিয়া ২/৩ বার লেখাটি পাঠ করে, আশেপাশে কারো কাছে কলম না পেয়ে সংগৃহীত একটি কাঠ পেন্সিল দিয়ে ওই খসড়ায় সই করেন। পরে, ওই খসড়া আবার নিয়ে এসেছিলাম জাতীয় প্রেসক্লাবে। বর্তমানে যেটি টিভি লাউঞ্জ, সেসময় এটি ছিল ক্যান্টিন।

নেত্রী শেখ হাসিনাসহ সব নেতা এখানেই বসা ছিলেন। যৌথ ঘোষণার কপি হস্তান্তর করেছিলাম রাজ্জাক ভাইয়ের কাছে। নেত্রী শেখ হাসিনা জানতে চাইলেন, ওনি পড়ে সই করেছেন কিনা, তাঁকে কোনও ফটোকপি দেওয়া হয়েছে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। আরো অনেক কথা মনে পড়ছে আজ । যা বলে শেষ হবে না।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখা হাসিনাকে সেদিন দুপুরের দিকে হাইকোর্টের সামনে কদমফুল ফোয়ারার কাছ থেকে তাঁর লাল পাজেরো জীপ গাড়িসহ গ্রেফতার করার চেষ্টা করেছিল এরশাদের পুলিশ বাহিনী। কিন্তু বুদ্ধি খাটিয়ে সেদিন শেখ হাসিনা গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন। পুলিশের তরফে হঠাৎ নেত্রীর গাড়ি আটকে পাশে রাখা একটি ক্রেন দিয়ে নেত্রীসহ গাড়িটি আটক করে ২/৩ হাত উপরে গাড়িটি তুলে ফেলেছিল।

নেত্রী ছিলেন গাড়ির সামনের আসনে বসা। পিছনের আসনে ছিলেন রাজ্জাকসহ দুজন। রাজ্জাক ভাইসহ নেতারা দ্রুত গাড়ি নেমে পড়তে পারলেও নেত্রীর সামনের দিক বেশ উঁচু থাকায় তিনি নামতে পারছিলেন না। আশেপাশে প্রচুর সংখ্যক নেতাকর্মী ও সাংবাদিক থাকায় পুলিশও এগুতে পারছিল না। এ অবস্থায় রাজ্জাক ভাই বলছিলেন ‘তুমি লাফ দাও, আমরা লুফে নেব’।

নেত্রীও সাহস করে লাফ দিলেন। কারো লুফে নিতে হয়নি। তিনি রাস্তায় নেমে এসে স্লোগান দিতে দিতে ফের প্রেসক্লাবে ফিরে এলেন। এ সময়ও পুলিশ নেত্রীকে আটক করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু,  ৮ দলের নেতা এবং উপস্থিত সাংবাদিকরা শেখ হাসিনাকে ঘিরে রাখায় তাও সম্ভব হয়নি।

প্রেসক্লাবে এসে নেতারা ঘন্টা দু-এক আপেক্ষা করেন। কানাকানি করে সিদ্ধান্ত নেন। একসঙ্গে নয়, আলাদা ভাবে গোপনে বেরিয়ে যাওয়ার। রাজ্জাক ভাইকে সাংবাদিক স্টিকার লাগানো মটর সাইকেলে ইনার সার্কুলার রোডের সাপ্তাহিক দেশবন্ধু অফিসে নিয়ে যান টিংকু ভাই। ন্যাপের পংকজ দা প্রেসক্লাবের পিছনের ওয়াল টপকে পার হন। বিকেলে নেত্রী অপর এক গাড়ি দিয়ে ধানমন্ডির বাসায় যান। অন্য নেতারা এরমধ্যেই কৌশলে প্রেসক্লাব থেকে গোপণ পথে বেরিয়ে যান।

লেখক: সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজেে

ইবাংলা/টিআর/১০ নভেম্বর ২০২১

Contact Us