বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় হত্যায় দণ্ডিত সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক এবং আকরাম হোসেনকে অনেকদিন ধরেই খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সম্প্রতি তাদের ধরিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণার পর নতুন করে আবার আলোচনায় এসেছেন তারা।
এ দুই জঙ্গি নেতা এখন কোথায় তা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। তারা দেশে না বিদেশে পলাতক, জীবিত আছেন না মারা গেছেন সেটি নিয়েও চলছে আলোচনা। মঙ্গলবার (২১ ডিসেম্বর) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল দাবি করেছেন, মেজর জিয়া ও আকরাম বিদেশে পালিয়ে গেছেন।
কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, আনসার আল ইসলামের (আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) এ দুই শীর্ষ জঙ্গি দেশেই আত্মগোপন করে আছেন। ফলে পলাতক দুই জঙ্গির অবস্থান নিয়ে দুই ধরনের বক্তব্যে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
জিয়া বাংলাদেশে রয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র ধারণা করলেও তা নাকচ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। মঙ্গলবার (২১ ডিসেম্বর) মানিকগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, আমাদের কাছে যতটুকু তথ্য আছে, দন্ডিত জিয়া ও আকরাম দেশে নেই। তারা অন্য দেশে গা ঢাকা দিয়েছেন। যত দ্রুত সম্ভব তাদের ধরে এনে রায় কার্যকর করা হবে। এ জন্য আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র বলছে, আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান মেজর জিয়া ৯ মাস আগে সংগঠনের দায়িত্বশীলদের কাছে নিজস্ব যোগাযোগ মাধ্যমে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এর পর আর তার কোনো তৎপরতা নজরে আসেনি। সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার হওয়া আনসার আল ইসলামের সদস্যদের কাছ থেকেও তার কোনো তথ্য মেলেনি। অর্থাৎ জিয়া এখন কোথায় আছেন এ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।
প্রযুক্তিগতভাবে সচেতন হওয়ায় জিয়া ডিজিটাল কমিউনিকেশন থেকে সব সময় দূরে থাকেন। সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করছেন ‘কাটআউট’ পদ্ধতি। গ্রেপ্তার এড়াতে সংগঠনের পুরনো সদস্যদের সঙ্গে একরকম ডিজিটাল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। নতুন সদস্যদের সঙ্গেও তার সাম্প্রতিক সময়ে কোনো যোগাযোগের তথ্য পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ জঙ্গিদের হুমকির মুখেও ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাকে নিয়ে একুশের বইমেলায় অংশ নিতে দেশে এসেছিলেন। ওই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে অভিজিতকে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। এ সময় জঙ্গিদের চাপাতির আঘাতে অভিজিতের স্ত্রী বন্যাও মারাত্মক আহত হন। ঘটনার পর গোয়েন্দা পুলিশের তদন্তে উঠে আসে হত্যার পরিকল্পনাকারী ও নির্দেশদাতা সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়ার নাম।
এর পর তাকে ধরতে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত টানা অভিযান চালান গোয়েন্দারা। এর মধ্যে বাড্ডা, টঙ্গি ও ঢাকার কেরানীগঞ্জে ৩টি বড় অভিযান পরিচালিত হয়। প্রতিবারই ধুরন্ধর জিয়া অল্পের জন্য পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এ ছাড়া চট্টগ্রামেও তার অবস্থান শনাক্ত হয়েছিল একবার। তবে জিয়াকে ধরতে ২০১৮ সালের পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনোযোগে কিছুটা ভাটা পড়ে।
২০১৬ সালে জিয়াকে ধরতে পুলিশ সদর দপ্তর ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। এ ছাড়া গত সোমবার (২০ ডিসেম্বর) যুক্তরাষ্ট্র সরকার অভিজিৎ হত্যায় জড়িত জিয়া ও আকরাম হোসেনকে ধরতে ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে। ফলে এ দুই জঙ্গিকে নিয়ে আবার নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জানা গেছে, নতুন করে তারা আনসার আল ইসলাম ও মেজর জিয়াকে ধরতে ছক আঁটা শুরু করেছেন। সম্ভাব্য কাদের ধরলে মেজর জিয়াকে কব্জায় নেওয়া সম্ভব হবে এমন জঙ্গিদের প্রাথমিক তালিকা তৈরির কাজও শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কোনো ইউনিট।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, কোনো পুরস্কার ঘোষণার সঙ্গে আমাদের কাজের সম্পর্ক নেই। আমরা মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ওই দুই জঙ্গিকে ধরতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা রয়েছে।
এদিকে মনোযোগে কিছুটা ভাটা পড়ার সুযোগে আনসার আল ইসলামের সাংগঠনিক কাঠামো দিনের পর দিন শক্ত হচ্ছে বলেই মনে করছেন সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, জঙ্গি সংগঠনটিতে নতুন সদস্য সংগ্রহ অব্যাহত রয়েছে।
চলমান রয়েছে দাওয়াতি কার্যক্রম। নতুন করে সংগঠনটির সামরিক শাখাও সংগঠিত করা হচ্ছে। সক্রিয় রয়েছে মুফতি বোর্ড, শূরা কমিটি, মিডিয়া ও ইন্টেলিজেন্স শাখাও। তাই এখন নতুন করে তাদের ওপর নজর দেওয়ার সময় এসেছে।
ইবাংলা/জেডআরসি/২২ ডিসেম্বর, ২০২১