১৯৭৩ সামরিক অভ্যুত্থান ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেনাপ্রধান জেনারেল অগাস্টো পিনোচেট চিলির সোসালিস্ট পার্টির নেতা প্রথম বামপন্থী রাষ্ট্রপতি সালভাদর আলেন্দেকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন। এই সামরিক অভ্যুত্থানের মূল মদদদাতা ছিলেন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন (১৯৬৯-৭৪) এবং তার সামরিক উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার। এগুলো এখন আর গোপন কিছু নয়, তাদের প্রকাশিত দলিলেই সে তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
চিলিতেই বিশ্বের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোন বামপন্থী নেতা ১৯৭০ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আলেন্দের বিজয়কে নিক্সন প্রশাসন গ্রহণ করেননি। আলেন্দে ছিলেন কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আলেন্দেকে হত্যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র লাতিন আমেরিকায় বামদের অগ্রযাত্রাকে রুখতে চেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তিতে মার্কিন শাসকদের সে স্বপ্ন সবটা সফল হতে দেয়নি ল্যাতিন আমেরিকার জনগণ।
একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও এই নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছেন ও পাকিস্তানের গণহত্যাকে সমর্থন করেছেন। এভাবেই মার্কিন প্রশাসন দেশে দেশে গণতন্ত্র, জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছেন। অন্যদিকে সারা দুনিয়ার মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের কথা বলে মুখে ফেনা তুলেছেন।
এ বছর জুলাইয়ে পেরু’র নির্বাচনে গ্রামের এক বামপন্থী স্কুল শিক্ষক পেদ্রো কাস্তিলিও নির্বাচিত হন। তখন এক কলামে লিখেছিলাম ল্যাটিন আমেরিকায় বামপন্থীদের প্রভাব বাড়ছে। বামপন্থীদের প্রভাব বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলেছিলাম এ দেশগুলোতে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈষম্য দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানী কথিত উদারবাণিজ্য নীতি ও সরকারের খবরদারীর কারণে মধ্য আমেরিকার দেশগুলোতে জনবিক্ষোভ বাড়ছে। এবং তাদের সমর্থক, তোষণকারী সরকারের জনপ্রিয়তা কমছে এবং দেশেদেশে তারা ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ছে।
নভেম্বরের মাঝামাঝি চিলিতে প্রথম দফার ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটাররা জাতীয় কংগ্রেস ও আঞ্চলিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করেন। এরপর সেখানে এগিয়ে থাকা দু’জন ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯ ডিসেম্বর, রবিবার চিলির রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার ভোটগ্রহণ শেষ হয়। সকল জরিপ-জল্পনাকে পিছনে ফেলে ৩৫ বছর বয়ষ্ক বামপন্থী সাবেক ছাত্রনেতা বোরিক গ্যাব্রিয়েল চিলির রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বোরিক হচ্ছেন বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপ্রধানদের একজন। ৯৯ শতাংশ ভোট কেন্দ্রের তথ্যমতে, বোরিক ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বী আন্তনিও কাস্ট পরাজিত করেছেন। তিনি পেয়েছেন ৪৪ শতাংশ ভোট। ৫৫ বছর বয়ষ্ক দক্ষিণপন্থী জোসে আন্তনিও কাস্ট ইতোমধ্যে বোরিকের বিজয়কে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
বোরিক ১৯৮৬ সালে চিলির একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে লেখাপড়া করেন যদিও তিনি তার স্নাতক সম্পন্ন করেননি। এ সময়ে তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অধিক মনোযোগী হন। তিনি চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বোরিক ২০১১ সালে মুক্তবাজারের সমর্থক দক্ষিণপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষাখাতে বৈষম্য, শিক্ষাব্যায় বৃদ্ধি ও শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের প্রতিবাদে হাজার হাজার ছাত্রকে পথে নামান। জনগণ কর্তৃক সমর্থিত এ আন্দোলনের মূলনায়ক ছিলেন বোরিক গ্যাব্রিয়েল। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে মানসম্পন্ন শিক্ষা, অবসরকালীন অধিক ভাতার দাবীতে আন্দোলন গড়ে তোলেন। চিলির বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার-পরিবর্তনের কথা বলেন।
গত একদশকে আর্থ-সামজিক খাতের আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে তিনি দেশটিতে ব্যাপক সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেন। দেশ-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেন। এর ধারাবাহিকতায় বোরিক জাতীয় রাজনীতিতে আসেন। ২০১৩ সালে তিনি কংগ্রেসে নির্বাচিত হন। এবং ২০১৬ সালে তিনি নতুন রাজনৈতিক দল ‘স্বায়ত্বশাসিত আন্দোলন’ গড়ে তোলেন।
৯০ সালে অগাস্টো পিনোচটের বিদায়ের পর চিলিতে গণতান্ত্রিক ধারা চালু হবার পর এক ধরণের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা তৈরী হয় ও অনেক অর্থনৈতিক অগ্রগতিও অর্জিত হয়। কিন্তু সমাজে তৈরী হয়েছে ব্যাপক বৈষম্য ও অসন্তোষ। অর্থনৈতিক-সামাজিক খাতে নাগরিক সুবিধা বাড়াতে শাসকরা মনোযোগ দেননি। ধনীকশ্রেণী ও বৃহত পুঁজির মালিকরা ফুলেফেপে ওঠায় জনবিক্ষোভ তৈরী হয়। শহর-গ্রাম ও ধনী-গরীব বৈষম্য বেড়ে যায়। ২০১৯’র এ সব ইস্যুর রাজনীতি ও জন বিক্ষোভ চিলির রাজনীতিতে তিনদশকের মধ্যে প্রথম এক পরিষ্কার মেরুকরণ তৈরী করে। ২০২১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সামনে রেখে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে জোট করে বোরিক নির্বাচনে বিজয় অর্জন করেন।
বোরিক তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায়ও বৃহত কোম্পানীগুলোর উপর অধিক কর আরোপ, রাষ্ট্রীয় পেনশন ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মাইনিং কোম্পানিতে সরকারী নিয়ন্ত্রন, পরিবেশের উন্নয়ন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বন্ধ, ছাত্রদের শিক্ষাঋণ বাতিল, ধনীকশ্রেণী ও বিত্তশালীদের কর বৃদ্ধি, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির উন্নতি, অভিবাসি নীতি গ্রহন, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও বৈষম্য কমিয়ে আনার কথা বলছেন। সাবেক স্বৈরশাসক অগাস্টো পিনোচটের করা সংবিধান পরিবর্তন-সংস্কার আলাপও এ নির্বাচনের একটি বড় বিষয় ছিল। ২০২২ সালের কোন এক সময় এ জন্য গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।
এ নির্বাচনে তাঁর জয় মোটেই সহজ ছিল না। নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি প্রতিপক্ষ শাসক ও তার সমর্থকদের দিক থেকে তীব্র আক্রমণের স্বীকার হন। জোসে বামদের জোটকে বিভিন্নভাবে অভিযুক্ত করেন। অন্যদিকে তিনদশক আগে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক স্বৈরশাসক জেনারেল অগাস্টো পিনোচেটের শাসনামলের পক্ষে কথা বলায় তাকেও ছেড়ে দেন না বোরিক। তাকেও রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়। সে যাইহোক, সালভেদর আলেন্দের পর চিলিতে বামপন্থীদের ক্ষতায় ফিরে আসা যে ল্যাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া জোড়ালো হচ্ছে, সে কথা ভর দিয়ে বলা যায়।
লেখক: গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
ইবাংলা / নাঈম/ ২৫ ডিসেম্বর, ২০২১