বাংলাদেশেও আমরা পুঁজিবাদের দুঃশাসনের ভিতরই রয়েছি। আমাদের তরুণরা অতীতে বিদ্রোহ করেছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মতো বড় বড় ঘটনা তাদের কারণেই সম্ভব হয়েছে। একাত্তরে তারা যুদ্ধ করেছে। এরশাদের পতনের পেছনেও তাদেরই ছিল সবচেয়ে বড় ভূমিকা। কিন্তু তাদের পক্ষে নিজেদের সেই ভূমিকা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। প্রধান কারণ রাষ্ট্র সেটা চায়নি এবং রাষ্ট্র পুঁজিবাদবিরোধী না হয়ে পুঁজিবাদের অনুসারী ও সেবকে পরিণত হয়েছে।
ব্রিটিশ শাসনের সময় এবং পাকিস্তান আমলে তো অবশ্যই, তরুণের বিদ্রোহ ছিল নতুন রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের জন্য। তাদের স্বপ্ন ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজের। গণতান্ত্রিক বলতে তারা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র বোঝেনি, বুঝেছে জনগণের রাষ্ট্র। যার মূল কথাটা হচ্ছে রাষ্ট্র এবং সম্পদের সামাজিক মালিকানা।
ব্রিটিশের রাষ্ট্র ছিল ঔপনিবেশিক, পাকিস্তানি রাষ্ট্রের চরিত্রও দাঁড়ায় অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক। ওই দুই দুষ্ট রাষ্ট্র চলে গেছে, একটির পর অন্যটি; কিন্তু আমাদের নতুন রাষ্ট্র নামে ভিন্ন হলেও স্বভাব-চরিত্র আগের দুই রাষ্ট্রের মতোই; আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। এই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও ঔপনিবেশিকতা জায়গা করে নিয়েছে। এ ঔপনিবেশিকতা বিদেশিদের নয়, স্বদেশিদেরই। তাই দেখতে পাই যে বিদেশিদের ঔপনিবেশিক শাসনে যেটা সত্য ছিল এখানেও তা মিথ্যা হয়ে যায়নি; সম্পদ পাচার সমানে চলছে।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বলেছেন, কারা টাকা পাচার করে তিনি জানেন না, জানা থাকলে যেন তাঁকে জানানো হয়। অথচ সবাই জানে দেশের টাকা দেশে থাকছে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের ভাষা বাংলা হয়নি; তিন ধারার শিক্ষা বিদ্যমান, তিনের মধ্যে জোরদার হচ্ছে ইংরেজি মাধ্যম।
ওই মাধ্যমে যারা পড়ে তাদের স্বপ্ন থাকে, বিশেষ একটা স্বপ্ন থাকে, সেটা হলো বিদেশে যাওয়া এবং পারলে সেখানেই থেকে যাওয়ার। মেহনতিদের সন্তানরা বিদেশে যায় দেশে টাকা পাঠাবে বলে, অবস্থাপন্নদের সন্তানরা যায় টাকা খরচ করতে এবং সেখানে থেকে যাওয়ার সুযোগ খুঁজতে। মেহনতিরা রাষ্ট্রশাসন করে না, অবস্থাপন্নরাই করে এবং শাসন যারা করে তাদের আদর্শই সমাজে গৃহীত হয়।
বাংলাদেশেও সেটাই ঘটেছে। এখানে সমষ্টিগত স্বপ্নের বড়ই অভাব। সমষ্টিগত স্বপ্ন একাত্তরে ছিল, পরে তা ভেঙে গেছে। পুঁজিবাদী উন্নতির ধারণা তাকে ভেঙে দিয়েছে। স্বপ্নগুলো এখন ব্যক্তিগত; একের স্বপ্ন অন্যের স্বপ্নকে কনুই দিয়ে গুঁতোয়, ঠেলে ফেলে দিতে চায় পায়ের নিচে, ভাবে অন্যকে দাবাতে না পারলে তার উঠতি নেই।
তরুণরাও শৈশব থেকে ওই শিক্ষাই পেয়ে আসছে। স্বার্থপর হওয়ার শিক্ষা। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণরা সামাজিক হওয়ার শিক্ষাটা পায় না। ঘরে তারা একাকী। প্রশস্ত ঘর অধিকাংশেরই নেই। তাদের সময় কাটে ঘরের অন্ধকার কোণে ইন্টারনেট ও মোবাইলে। খেলার মাঠ নেই, সামাজিক অনুষ্ঠানের সুযোগ অনুপস্থিত; নাটক দেখবে বা করবে এমন কথা ভাবতেও পারে না; সিনেমা যে দেখবে এমন সিনেমা হলও নেই। কোনো কাজে তারা উৎসাহ পায় না। ফেসবুক তাদের বিপথগামী করতে চায়। কেউ কেউ ড্রাগে আসক্ত হয়েছে, অনেকেই হওয়ার পথে। বর্ণনা দীর্ঘ করা অনাবশ্যক; শুধু এটুকু স্মরণ করলেই হয়তো তারুণ্যের প্রতি রাষ্ট্র শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গি জানা যাবে যে গত ৩০ বছর ধরে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কার্যকর কোনো ছাত্রসংসদ নেই।
অথচ ছাত্রসংসদ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অপরিহার্য অংশ। ছাত্রসংসদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সামাজিক হয়, সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে, সুযোগ পায় মেধা বিকাশের। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে বসে থাকে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু মিলিতভাবে যে কোনো সৃষ্টিশীল কাজে অংশ নেবে তেমন সুযোগ পায় না। অথচ একসময় পেত। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, তখন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ ছিল এবং থাকারও কথা।
আইয়ুব খান ছাত্রদের সর্বপ্রকার রাজনৈতিক কাজ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল; কিন্তু ওই তার ভয়াবহ সময়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদের নির্বাচন হয়েছে এবং নির্বাচিতরা গণতন্ত্রের পক্ষে আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদের শাসনের কালেও ছাত্রসংসদ সজীব ছিল। কিন্তু এরশাদের পতনের পর যখন চারদিকে আওয়াজ শোনা গেল যে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটেছে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেতে যাচ্ছে ঠিক তখন থেকেই কিন্তু ছাত্রসংসদের নির্বাচন বন্ধ হয়ে গেল।
দেশে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে, নির্বাচনের দরুন সরকারের রদবদলও ঘটেছে। কিন্তু হায়! ছাত্রসংসদের প্রাণ ফিরে আসেনি। কোনো সরকারই আগ্রহ দেখায়নি। অন্যান্য ক্ষেত্রে ভীষণ পরস্পরবিরোধী মনোভাবাপন্ন হলেও এ ব্যাপারে তাদের ভিতর চমৎকার মিল দেখা গেছে। এ মিল নিশ্চয়ই তাৎপর্যহীন নয়। দেশের বুর্জোয়া শাসকরা তরুণকে যে সন্দেহের চোখে দেখে এটি তারই একটি নিদর্শন।
ছাত্রসংসদ নেই, নির্বাচন হয় না, শিক্ষার্থীরা সুস্থ সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশ এবং নেতৃত্বদানে প্রস্তুতির সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকে। তাই বলে দলীয় আধিপত্য যে নেই সেটা মোটেই সত্য নয়। সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠন সেখানে দুই ধরনের কাজ করে। একটা হচ্ছে ভিন্নমত দমন; অন্যটা আধিপত্যের সুফল লাভ। প্রথমটির চরম দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে আবরার হত্যার ঘটনা।
দ্বিতীয়টির অর্থাৎ আধিপত্যের সুফল লাভের সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন একটি খবর পাওয়া গেল একটি দৈনিক পত্রিকায় (আজকের পত্রিকা, ২৮.১০.২০২১) যাতে বলা হচ্ছে- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসে সিট বিক্রি করেছে ছাত্রলীগ নেতারা। ছাত্রাবাসে সিট খালি হলে নিয়ম অনুযায়ী প্রশাসন সিট বণ্টন করে; কিন্তু সে বণ্টন কার্যকর হয় না, কারণ সিট পেয়েছে যে ছাত্র সে ঢুকতে পারে না। তার জায়গায় সিট যে কিনেছে তার বসবাসের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়।
ব্যবস্থাটা বেশ পুঁজিবাদী এবং সে কারণে অন্যত্র প্রচলিত সামন্তবাদী গণরুম ব্যবস্থার তুলনায় উন্নত। গণরুমে গাদাগাদি করে কোনোমতে থাকা যায়, কিন্তু নেতারা এলে লাফিয়ে উঠে সালাম দিতে হয় এবং মিটিং মিছিলে সে্লগান দিতে দিতে নিয়মিত শামিল হওয়া কর্তব্যের মধ্যে থাকে। গতর খাটা ওই ব্যবস্থা তুলনায় নগদ মূল্যে কেনা ব্যবস্থাটা মানবিকও বটে।
তবে সামন্তবাদও কম নাছোড়বান্দা নয়। অর্থনীতি থেকে বিদায় নিলেও সংস্কৃতির আশ্রয় ছাড়তে চায় না। সেজন্য আধিপত্য, ক্ষমতা ও চাঁদা তোলা পরস্পর নির্ভরশীল অবস্থায় রয়ে যায়। এসব নিয়ে নিজেদের মধ্যেও লড়াই চলে। কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে সরকার-সমর্থক ছাত্রদেরই দুই পক্ষ ভীষণ রকমের মারামারি করেছে, তাতে একজন ছাত্রের মাথার খুলি ফেটে গেছে। চিকিৎসকদের দক্ষ চিকিৎসা ও যতে ছেলেটি শেষ পর্যন্ত জীবনীশক্তি ফিরে পেয়েছে, নইলে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল।
এ ঘটনার পেছনে যে শুধু মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগের দুই পক্ষ জড়িত তা নয়, জানা যাচ্ছে নগর আওয়ামী লীগের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ধারাও অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে ছিল। কলেজ যথারীতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল; খোলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে ৩১ জনকে বহিষ্কার করেছেন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তা নিয়েও বিরোধ বেধেছে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের; এক পক্ষ বলছে অন্য পক্ষের বেশি দোষ, অথচ তারা শাস্তি পেয়েছে কম। বিপাকে পড়েছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। টের পাচ্ছেন তাঁরা যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাটা কত কঠিন।
আমরা পছন্দ করি কি না করি বৈজ্ঞানিক সত্য এটাই যে দ্বন্দ্ব জিনিসটা থাকবে, থাকছেই। বিরোধী দল না থাকলে নিজের দলের মধ্যেই দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। যেমনটা দেখা গেছে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। সেখানে বিএনপি নেই। তারা নির্বাচন বর্জন করেছে। তাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই প্রার্থীরা নির্বাচিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। অনেকে হয়েছেনও। এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৪৮ জন চেয়ারম্যান (প্রথম আলো, ২১.১১.২০২১) প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করেই জিতে গেছেন। কিন্তু তাই বলে হানাহানি থেমে থাকেনি।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইবাংলা / নাঈম/ ০৯ জানুয়ারি, ২০২২