ভয়াবহ, নৃশংস, নিষ্ঠুর-নির্মম বীভৎস রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞের রক্তাক্ত দিন ২১শে আগস্ট। মৃত্যু, ধ্বংস, রক্তস্রোতের নারকীয় গ্রেনেড হামলার আঠারো বছর আজ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা পরবর্তী ইতিহাসের বীভৎস হত্যাকান্ড চালানো হয় ২০০৪ সালের এই দিনে। গ্রেনেডের হিংস্র দানবীয় আঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল বিভিন্ন নেতাকর্মীর শরীর। রক্ত ও বারুদের গন্ধে মলিন হয়ে গিয়েছিল মানবতা। নৃশংস, বর্বরোচিত সেই হত্যাকাণ্ডের পর সমাবেশস্থল নিমিষেই মৃত্যুপুরিতে পরিনত হয়েছিল। কেন ও কি উদ্দ্যেশ্যে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ তার জবাব কে দিবে? প্রকৃতপক্ষে ২১শে আগস্টে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ আরেকটা ১৫ই আগস্ট সৃষ্টির অপচেষ্টা নয় কি?
আরোও পড়ুন……ডিমের বাজার অস্থির!
মূলত , রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামীলীগকে সম্পূর্ণ নেতৃত্বশূন্য করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করাই ঘাতকদের হত্যাকাণ্ডের মূল টার্গেট ছিল। ওই ঘটনার মাধ্যমে জাতির সামনে দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে উঠে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আবারও একাত্তরের পরাজিত অপশক্তির প্রতিশোধস্পৃহা ও পৃষ্ঠপোষকতায় খোদ রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে প্রকাশ্যে চালানো হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত গ্রেনেড দিয়ে বর্বরোচিত সেই হামলা। মূলত বিএনপি জামাত ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুর দর্শন, গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংসে পথের কাটা হিসাবে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। বর্বরোচিত হামলার পর সেদিনের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তির সমাবেশ রীতিমতো মৃত্যুপুরীতে পরিনত হয়েছিল । মুলত শোকের মাসে একাত্তরের পরাজিত শক্তির মদদপুষ্ট হয়ে জঙ্গিগোষ্ঠী পূর্বপরিকল্পিত গ্রেনেড হামলার মধ্যদিয়ে শোকাবহ মাসে আরেকটি ১৫আগস্ট সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছিল । নৃশংস ওই হামলার ঘটনায় দেশ বিদেশসহ বিভিন্ন জায়গায় নিন্দার ঝড় বয়ে গেলেও বিএনপি জামায়াত জোট মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আলামত নষ্টসহ হেন কোন কাজ নেই যা তারা করেনি । হাওয়া ভবনে বসে জজ মিয়ার মত মিথ্যা নাটক সাজানোর ঘটনাতো এখন দেশবাসীর মুখে মুখে। সেদিন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী থেকে শুরু করে অনেকেই যে এই নারকীয় হত্যার সাথে জড়িত ছিল তা দীর্ঘ ১৪ বছর আদালতের রায়ে জাতির সামনে আজ দৃশ্যমান।
সেদিন আওয়ামীলীগের নিবেদিত নেতাকর্মীরা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে মানবঢাল রচনা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হিংস্র শ্বাপদের ভয়াল ছোবল থেকে রক্ষা করেছিল। বিভীষিকাময় সেই হামলায় অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হারিয়েছিলেন তাঁর দু’কানের স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি। সেদিনের বর্বর হামলায় ঝড়ে পড়েছিল বেগম আইভি রহমানসহ ২৪টি তরতাজা প্রাণ। আহত হওয়া সেদিনের ৫০০ এর বেশি নেতাকর্মী স্প্লিন্টারের আঘাতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ হারিয়ে চিরদিনের জন্য পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্বকে বরণ করে জীবন্মৃত অবস্থায় অভিশপ্ত জীবন কাটাচ্ছেন । অবিভক্ত ঢাকার নির্বাচিত প্রথম মেয়র, মোহাম্মদ হানিফ শরীরে বিঁধে থাকা স্প্লিন্টারের কষ্ট ভোগ করেই অবশেষে মৃত্যুর কাছে হেরে গেলেন।
দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ভয়ংকর ও বিভীষিকাময় গ্রেনেড হামলার রায় হয়েছিল ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ । রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জঙ্গি নেতা মুফতী হান্নান ও বিএনপি সরকারের শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক এমপি কায়কোবাদ ও হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। এই ভয়াল ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় তৎকালীন বিএনপি জামায়াত জোট সরকার যে জড়িত তা পূর্নাঙ্গ রায়েই প্রমাণিত হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অতীতের ন্যায় আওয়ামীলীগ – বিএনপির আন্তরিকতার জায়গাটিকে একেবারেই পঙ্গু করে দিয়েছে।
সে দিন আসলে কি হয়েছিলো? তার বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি – মূলত ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বিকেলে ৫ টা ২২ মিনিটে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ এ জঙ্গিদের ৬৩ জেলায় সন্ত্রাস ও বোমা হামলার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে অস্থায়ী ট্রাকমঞ্চ থেকে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তৃতা শেষ করে ট্রাক থেকে নামার পূর্ব মুহূর্তেই শুরু হলো নারকীয় গ্রেনেড হামলা। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হতে লাগল একের পর এক গ্রেনেড। সেই মুহুর্তে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউ পরিণত হলো মৃত্যুপুরীতে। সেদিন বৃষ্টির মত শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ১৩ টি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ করে হায়েনারা। খুনীদের প্রধান লক্ষ্যই ছিল শেখ হাসিনা। সেই সময় মঞ্চে অবস্থানরত নেতৃবৃন্দ ও শেখ হাসিনার নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মীর আত্নত্যাগ, নেতাকর্মীদের মানব ঢাল ও আল্লাহর অশেষ রহমতে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে উঠে প্রাণে বেঁচে গেলেও খুনীরা ক্ষান্ত হয়নি। তারা শেখ হাসিনাকে বহনকারী গাড়িতে ছুঁড়েছিল গ্রেনেড ও বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি । একেবারে পরিকল্পিত ও টার্গেট করা ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গুলি ভেদ করতে পারেনি শেখ হাসিনাকে বহনকারী বুলেটপ্রুফ গাড়ির কাচ। সেই জন্য গুলি করে তার গাড়ির চাকা পাঞ্চারের মাধ্যমে গাড়ির গতিরোধ করে হত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করেছিল ঘাতকরা। শুধু তাই নয়, খুনীদের টার্গেটকৃত গ্রেনেড ও বুলেট থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে রক্ষায় বুলেটের সামনেই আত্নাহুতি দিতে হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী মাহবুবুরকে।
‘রাখে আল্লাহ, মারে কে’ অর্থাৎ পরম করুনাময়ের দয়ায় সেদিন তিনি এই বাংলার মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য হয়তো বেঁচে গেলেন। সে সময় গ্রেনেড ও বারুদের আকস্মিকতায় অন্ধকারে ছেয়ে যায় বঙ্গনন্ধু এভিনিউ। বিস্ফোরকের বীভৎসতায় রক্ত-মাংসের ভাগাড়ে পরিণত হয় সমাবেশস্থল। সেদিন স্প্লিন্টারের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন শত শত নেতাকর্মী । আকস্মিক মৃত্যু আর রক্তস্রোতে লণ্ডভণ্ড শান্তিপ্রিয় অসংখ্য মানুষের দেহের বিভিন্ন অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। নেতাকর্মীর রক্তে লাল হয়ে যায় ঢাকার পিচঢালা রাজ পথ। অস্থায়ী সভামঞ্চের চারদিকে রক্তে ভেজা মুমূর্ষুদের বাঁচার আর্তচিৎকার, আর্তনাদের অবর্ণনীয় মর্মান্তিক দৃশ্য।
১৪ বছর পরে হলেও অমানবিক বর্বরোচিত নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম শেষ হওয়া জাতি বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেয়েছে । প্রায় ১৯ বার মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখা, বাবা-মা, ভাইসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্যের মৃত্যু শোকে নীলকন্ঠ হয়ে বেঁচে থাকা, জেল জুলুম অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করা, স্বল্প সময়ে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করে স্বপ্ন দেখানো নেতৃত্বই শেখ হাসিনা। সেই নেতৃত্বকে হত্যার মধ্যদিয়ে ঘাতক চক্র আরেকটি ১৫ই আগস্টের স্বপ্ন দেখেছিল। আত্নত্যাগী নেতা কর্মী ও পরম করুনাময়ের অপরিসীম দয়ায় ঘাতকদের দিবা স্বপ্নকে কবর দিয়ে এখন তিনিই আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার।
ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
লেখক, গবেষক ও তরুণ কলামিস্ট
সভাপতি – সিএসই এলামনাই এসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
Email- fokoruddincse@gmail.com
ইবাংলা/আরএস/২১ আগস্ট। ২০২২