চট্টগ্রামের সাবেক পুলিশ সুপার ( বরখাস্তকৃত এসপি) বাবুল আক্তারের পরিকল্পনা ও অর্থায়নেই স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে হত্যা করা হয় বলে পিবিআইয়ের তদন্তে উঠে এসেছে। তদন্ত বলছে, অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্কের জেরে বাবুল স্ত্রী মাহমুদাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এ জন্য সোর্সের (তথ্যদাতা) মাধ্যমে তিনি তিন লাখ টাকায় খুনি ভাড়া করেন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মাহমুদা হত্যা মামলায় পিবিআইয়ের তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে। এতে বাবুলসহ সাতজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করা হয়েছে। পিবিআইয়ের তদন্তের সঙ্গে একমত পোষণ করে অভিযোগপত্র দাখিলের পক্ষে মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) মত দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি। আগামী সপ্তাহে পিবিআই আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিতে পারে বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন…যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে
২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড় এলাকায় গুলি করে ও কুপিয়ে মাহমুদাকে হত্যা করে দুর্বত্তরা। এ সময় তিনি বড় ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে জিইসি মোড়ে গিয়েছিলেন। ঘটনার সময় বাবুল ঢাকায় ছিলেন।পরে তিনি চট্টগ্রামে গিয়ে ওই ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে হত্যা মামলা করেন। বাবুলের করা মামলার অভিযোগপত্রে তাঁকে প্রধান আসামি করা হচ্ছে।
অভিযোগপত্রে নাম আসা অন্য ছয় আসামি হলেন মো. কামরুল ইসলাম শিকদার মুসা, এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা, মো. মোতালেব মিয়া ওয়াসিম, মো. আনোয়ার হোসেন, মো. খাইরুল ইসলাম ওরফে কালু ও শাহজাহান মিয়া। এঁদের মধ্যে মুসা ও খাইরুল ঘটনার পর থেকে পলাতক। বাবুল, ওয়াসিম, শাহজাহান ও আনোয়ার কারাগারে আছেন। আর এহতেশামুল জামিনে আছেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অভিযোগপত্রে চারজনকে মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। এঁরা হলেন সাইদুল ইসলাম শিকদার ওরফে সাক্কু, নুরুন্নবী, মো. রাশেদ ও আবু নাছের। এঁদের মধ্যে রাশেদ ও নুরুন্নবী ঘটনার কয়েক দিন পর পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্য নারীর সঙ্গে বাবুলের অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে- এমন বিষয় মাহমুদা জানার পর দুজনের সম্পর্কে অবনতি হয়। এরপরই তিন লাখ টাকায় ভাড়াটে খুনি দিয়ে বাবুল তাঁর স্ত্রীকে খুন করান। সাক্ষী ও আসামিদের জবানবন্দী এবং তদন্তে খুনের পুরো চিত্র উঠে এসেছে। পিবিআই তদন্তের সাক্ষ্য স্মারকের সারসংক্ষেপ (এমই) দিয়েছে। তদন্তে একমত পোষণ করে অভিযোগপত্র জমা দিতে মতামত দিয়েছি।’
পিবিআই তদন্তে আরও বলা হয়, গত বছরের ২৩ অক্টোবর এহতেশামুল আদালতে জবানবন্দি দেন। এতে তিনি বলেন, বাবুলের নির্দেশে কামরুল শিকদার তাঁর স্ত্রী মাহমুদাকে খুন করেন। নির্দেশ না মানলে তাঁকে ‘ক্রসফায়ারে’ দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন বাবুল।
আরও পড়ুন…তারেক কানেকশন : আওয়ামী লীগে ভর করে হাশেম রেজার অস্বাভাবিক উত্থান
কামরুল ঘটনার পর থেকে ‘নিখোঁজ’। অনেক চেষ্টা করেও তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি। অবশ্য কামরুলের স্ত্রী পান্না আক্তারের দাবি, তাঁর স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে তাঁর আর খোঁজ পাচ্ছেন না তাঁরা। এর আগে ২০১৬ সালে ওয়াসিম ও আনোয়ার আদালতে জবানবন্দি দেন। তখন তাঁরা বলেন, কামরুলের নির্দেশে তাঁরা মাহমুদাকে খুন করেন।
পিবিআইয়ের তদন্তে বলা হয়, স্ত্রী হত্যার তিন দিন পর বাবুল তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার সাইফুল হককে তাঁর লাভের অংশ থেকে তাঁকে তিন লাখ টাকা দিতে বলেন। সাইফুল ওই টাকা বিকাশের মাধ্যমে গাজী আল মামুনকে পাঠান। আল মামুন ওই টাকা এহতেশাম, ওয়াসিমসহ আসামিদের মধ্যে ভাগ করে দেন। গত বছরের ১১ মে সাইফুল ও মামুন আদালতে সাক্ষী হিসেবে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য তুলে ধরেন।
পিবিআইয়ের প্রস্তুত করা অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০১৩ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাবুল কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গে বাবুলের সম্পর্ক হয়। ওই নারী তখন যে বাসায় থাকতেন, সেই বাসার নিরাপত্তাকর্মী সরওয়ার আলম ও গৃহকর্মী পম্পি বড়ুয়া গত ১৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন। এতে দুজনই কক্সবাজারে ওই নারীর বাসায় বাবুলের যাতায়াতের বর্ণনা দেন।
ওই নারী বাবুলকে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। মামলার আলামত হিসেবে এটি জব্দ করে পিবিআই। পরে আদালতের নির্দেশে হাতের লেখা পরীক্ষা করে দেখা যায়, উপহারের বইয়ে থাকা লেখা বাবুলেরই। ওই লেখায় তাঁদের দেখা, পরিচয়সহ নানা তথ্য রয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগরের পরিদর্শক আবু জাফর মো. ওমর ফারুক বলেন, অভিযোগপত্রে বাদী বাবুলসহ সাতজনকে আসামি করা হয়েছে। এতে সাক্ষী রাখা হয়েছে ৯৭ জন। আগামী সপ্তাহে অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হবে।
পিবিআইয়ের তদন্ত সমর্থন করে মাহমুদার বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ওই নারীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের জেরে বাবুল প্রায়ই তাঁর মেয়েকে নির্যাতন করতেন। বিষয়টি নিয়ে তখন পারিবারিকভাবে সালিস বৈঠকও হয়। মৃত্যুর আগে মেয়ে হত্যার বিচার দেখে যেতে চান তিনি।
তবে বাবুলের ভাই হাবিবুর রহমান এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে কোনো নারীর সম্পর্ক ছিল না। তাঁর ভাইকে ফাঁসানো হয়েছে। তাঁর ভাইয়ের নির্দেশে কামরুল সবকিছু করেছে বলা হচ্ছে। অথচ ছয় বছরেও কেন তাঁর হদিস পায়নি পুলিশ। আগে তাঁকে খুঁজে বের করা হোক।
আরও পড়ুন…কয়লা সরবরাহ সংকটেও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যহত
মাহমুদা হত্যার পরদিন ২০১৬ সালের ৬ জুন বাবুল বাদী হয়ে নগরের পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে পিবিআই এই মামলায় গত বছরের ১২ মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। একই দিন বাবুলের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন পাঁচলাইশ থানায় আরেকটি হত্যা মামলা করেন। এই মামলায় বাবুল আক্তারসহ আটজনকে আসামি করা হয়। ওই দিনই বাবুলকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। পরে মোশাররফের করা মামলায় পিবিআই চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিলে গত ২৫ জানুয়ারি আদালত তা গ্রহণ করেন। অন্যদিকে বাবুলের করা মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালত গ্রহণ করেননি।
সূত্র : প্রথম আলো
ইবাংলা/টিএইচকে/২৪আগস্ট,২০২২