বাকশাল নিয়ে বিরোধীদের আয়নাবাজি

ইবাংলা ডেস্ক

আজীবন গণতন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কোন আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অগ্রসরমান সমাজতন্ত্র বাকশালে উদ্ভুদ্ধ হলেন? কেন মাও সেতুং, হো চি মিন, ফিদেল কাস্ত্রোর মত সমাজতান্ত্রিক নেতৃত্বকে প্রগতির মডেল মনে করলেন? কোন দৃশ্যপটের কারণে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রকে দেশের উন্নয়নের জন্য প্রতিবন্ধকতা মনে করলেন? কোন অবস্থার প্রেক্ষিতে দেশের সকল সামরিক, বেসামরিক,রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী ও আমলাকে এক প্লাটফর্মে এনে বাকশাল গঠন করেছিলেন? এসবের উত্তর জানতে স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক পরিস্থিতি, একাত্তরের পরাজিত শত্রু এবং সর্বপরি স্বাধীনতা বিরোধী রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা কেমন ছিল তা উপলব্ধি না করে বাকশাল নিয়ে বিরোধীদের আয়নাবাজি চিলে কান নেওয়ার মত ঘটনা নয় কি?

আরোও পড়ুন………তারেক কানেকশন : আওয়ামী লীগে ভর করে হাশেম রেজার অস্বাভাবিক উত্থান

১৯৭৫ এর ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় ব্যবস্থার বদলে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করে বঙ্গবন্ধুকে সব দলের সমন্বয়ে একটি নতুন জাতীয় ঐক্য গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঐ ঐক্যের কাজ ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের বিভিন্ন অস্থিরতা দূর করে জাতির পুনর্গঠনের কাজ করা। দীর্ঘ ৩৮ বছর সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় দ্বিতীয় বিপ্লব বাস্তবায়নে সর্বজনীন জাতীয় মঞ্চ গঠনের উদ্যেশ্য ও রুপরেখা উপস্থাপন করেছিলেন । অতঃপর ৭ই জুন মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া ক্ষমতাসীন আওয়ামলীগসহ চারটি বিরোধী দল বিলুপ্ত করে অভিন্ন জাতীয় ফ্রন্ট বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামীলীগ ( বাকশাল) গঠন করেছিলেন।

আসলে, সত্তরের দশকে বিশ্ব রাজনীতিতে সমাজতন্ত্রের প্রভাব ছিল অপরিসীম । শুধু তাই না, দেশের প্রধান বিরোধী দল ন্যাপ ( ভাসানী) ছিল গণচীনের একনায়কতন্ত্রের একনিষ্ঠ সমর্থক। জাসদের গণবাহিনী, সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি ও মোহাম্মদ তোয়াহার সাম্যবাদী দল ছিল একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত। সেই সময় একদিকে বাম দলগুলোর মাধ্যমে ১১ জন এম.পি সহ প্রায় ৫০০০ হাজার মানুষকে গুপ্ত হত্যা , স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি আক্রমণ, অসংখ্য পাটের গুদামে আগুন, প্রায় ৫৪টি থানা থেকে অস্ত্র লুটপাট করে চুরি, ডাকাতি অপরদিকে কিছু কিছু দলছুট আওয়ামীলীগ কর্মীর সীমাহীন দুর্নীতি এবং ৭৪ এর প্রবল বন্যায় দেশের অর্থনীতির ভঙ্গুরতা। । অন্যদিকে বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করে ২২ লক্ষ মেট্রিক টন খাদ্য সাহায্য স্থগিত করেছিল সমাজতান্ত্রিক কিউবায় পাট রপ্তানির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। যার কারণে যুদ্ধ বিধস্ত বাংলাদেশে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের ফলে প্রায় ২৭ হাজার মানুষের মৃত্যু বঙ্গবন্ধুকে ভিন্ন ধাতুতে রুপান্তরিত করে। এই কারণেই কি বঙ্গবন্ধুর মোহভঙ্গ ঘটেছিল শোষণের নামে উদারনৈতিক গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রতি?

সে সময় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের অসহায় রুপ দেখে বিচলিত হয়ে স্বল্পসংখ্যক ধনিক মজুতদার, কালোবাজারি, অসৎ রাজনীতিবিদ, পেশাজীবি ও মুনাফালোভী দুর্নীতিবাজ থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট বন্ধ করার নিমিত্তে বঙ্গবন্ধু বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাকশালের গঠনতন্ত্রে বলা হয়েছিল বাধ্যতামূলক সমবায় ভিত্তিক সমাজ প্রণয়নে গ্রামের সব মানুষ এক হয়ে সরকারি উপকরণ ব্যবহারে জমি চাষ করবে আর উৎপাদিত ফসল তিন ভাগ হয়ে যাবে জমির মালিক, চাষে নিয়োজিত শ্রমিক ও সরকারের কোষাগারে। এমনকি সকল পেশাজীবী ও রাজনৈতিকরা যেকোন নির্বাচনের পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করতে পারবেন। নির্বাচিত সংসদের দুই তৃতীয়াংশের অনাস্থা ভোটে প্রেসিডেন্ট অপসারিত হবেন। শুধু তাই না – বিচার কার্যের দীর্ঘসূত্রীতা দূর করার জন্য আদালতের কার্যক্রম উপজেলা পর্যায়ে নেওয়ার পরিকল্পনাও ছিল।

বাকশাল কি একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু নিজেই সাংবাদিক আবির আহাদকে বলেছিলেন – মোটেই না। এটা ছিলো সম্মিলিত বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ৭৩ এর নির্বাচনেও সংখ্যাগরিষ্ঠ সিট আওয়ামী লীগই পেয়েছিল। তখন বিরোধী দল বলতে ছিলো ন্যাপ ভাসানী, ন্যাপ মোজাফফর, সিপিবি ও জাসদ। ভাসানী নির্বাচনে না গিয়ে স্বাধীনতাত্তোর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ, মুসলিম বাংলা গঠন ও আওয়ামী শাসনের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে অনশন করতে থাকেন । আর জাসদ ও সর্বহারা পার্টি করতো গুপ্তহত্যা, চুরি, ডাকাতি ও লুটপাট । সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতার জন্য মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী,পিডিপি ও নেজামে ইসলামী নিষিদ্ধ ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে দেশের সক্ষমতা অর্জনের দ্বিতীয় বিপ্লবে বঙ্গবন্ধুর জাতীয় ঐক্যের ডাকে ন্যাপ মুজাফফর এবং সিপিবি যুক্ত হওয়ায় আওয়ামীলীগ সহ তিনটি দলের সমন্বয়ে অভিন্ন জাতীয় ঐক্য বাকশাল গঠিত হয়েছিল । সেই সময়ে চার বিরোধী দলের দুইটি জাতীয় ঐক্যে যোগদান করে আর বাকি দুইটা বিরোধিতা করলে বাকশাল স্বৈরাচারী হয় কিভাবে?

এর পরও যারা বাকশালকে একদলীয় ব্যবস্থা বলে মনে করেন তাদের উপলব্ধি করা শ্রেয় -ইসলামে একটি মাত্র দল ছিল খেলাফতে রাশেদীন। মার্কসবাদও একটি মাত্র জাতীয় দলের অনুমোদন দিয়েছে। রাশিয়া, ভিয়েতনাম, বিভিন্ন ইসলামী রাষ্ট্র, ইরান ও কিউবায় কতটি দল ছিলো ? বঙ্গবন্ধুর ভাষায় , “সারা বিশ্ব দু’ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে “। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল ছিলো সেই সময় শোষিত-বঞ্চিত- নির্যাতিত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা । সেই জন্য তিনি ৯৫ ভাগ কৃষক শ্রমিক মানুষকে সংঘবদ্ধ করেছিলেন তাদের নিজেদের নামেই সংগঠিত জাতীয় প্ল্যাটফর্ম বাকশালে। মূলত বাকশাল ছিলো সর্বশ্রেণী বাঙালীর অভিন্ন জাতীয় প্লাটফর্ম।

আফসোস, খোদ আওয়ামী লীগের অনেকেই বাকশাল সম্পর্কে ভাল জানেন না। এই সুযোগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী বাকশাল কর্মসূচিকে একদলীয় শাসনব্যবস্থা হিসেবে অপপ্রচার করে গোলাপানিতে মাছ শিকারের সুযোগ নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংস হত্যার পর শোষিত গণতন্ত্রের স্বপ্নের যবনিকাপাত ঘটায় । শুধু তাই না, ইনডেমনিটি আইন জারির মাধ্যমে খুনীদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনকি রাষ্ট্রের সর্বত্র বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়াও প্রায় ২১ বছর নিষিদ্ধের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নামে সর্বত্র নানান আষাঢ়ে গল্প ছড়িয়ে দিয়েছিল।

শোষিতের গণতন্ত্র বাকশল ছিল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যার অর্থনৈতিক অংশটুকু ছিলো সমাজতান্ত্রিক। বাকশাল কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে উপরতলার শোষণ চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত। তাই এর বিরোধিতা করেছিল উঁচু তলার সুবিধাভোগী শোষক শ্রেণী । প্রকৃতপক্ষে বাকশালের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু পুঁজিবাদী, ভোগবাদী, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক দাসত্ত্বযুক্ত ঘূণেধরা সমাজব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে চেয়েছিলেন। বাকশাল ছিল সেই সময় সবচেয়ে সাম্যবাদী শাসনব্যবস্থা । সেই ব্যবস্থাকে না বুঝে সমালোচনা করা আর মুজিব হত্যায় বুদ্ধিবৃত্তিক সমর্থন দেয়া সমান নয় কি?

যে বাকশালের জন্য অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা জায়েজ করতে চান, সেই বাকশাল কার্যকর হওয়ার কথা ছিলো পহেলা সেপ্টেম্বর। আজ প্রায় অর্ধ শতাব্দী পর দেশে দেশে গণতন্ত্রে বিভক্তি, পুজিবাদের দৌরাত্ব, চীন, রাশিয়া, কিউবা, ভিয়েতনাম কিংবা ইরানের উদাহরণ সামনে রাখলে বাকশালকে ফ্যাসিবাদের অপর নাম হিসাবে ঢালাও দায়ী না করে বরং একটি বৈষম্যহীন উন্নয়নমুখী সমাজ প্রতিষ্ঠায় এক সফল রাষ্ট্রনায়কের স্বপ্ন হিসাবেও পাঠ করা যায় কি?

ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
লেখক, গবেষক ও সমাজকর্মী।
সভাপতি, সিএসই এলামনাই এসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

ইবাংলা/আরএস/২৯ আগস্ট, ২০২২

বাকশাল