কয়েক দশকে চীন প্রাকৃতিক সভ্যতার নির্মাণ, সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে এগিয়ে যাওয়ার ফলশ্রুতিতে চীন তাঁর স্থানীয় অর্থনীতি উন্নয়নের নতুন উপায় খুঁজে পেয়েছে। যা প্রাকৃতিক সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে চীনের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্বকে নতুন নতুন পরিকল্পনা প্রদান করে আসছে।
শেনচেনে জনসংখ্যার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। নগরের কেন্দ্রীয় অঞ্চল বলে ডাকা হয় এই শেনচেন বেইকে। সেখানে ম্যানগ্রোভ বন সাগর, শহর, পাখি ও মানুষ একাকার হয়ে আছে। এখানে প্রতি ১০০ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বন প্রতিবছর প্রায় ৪০০০ টন কার্বন -ডাই -অক্সাইড শোষণ করে। পাশাপাপুনরুদ্ধারেরশি, শেনচেন শহরে তাপ দ্বীপের প্রভাব কমিয়ে এনেছে।
প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ পাখি এখানে এসে শীতকালের সময় অতিবাহিত করে এই সময় অনেকে এসে ছবি তুলেন এবং শিশুরা এখানে প্রকৃতি সম্পর্কে আরও বেশি জানতে পারে।
আরও পড়ুন— সংস্কারকে জোরদারের নির্দেশনা চীনা প্রধানমন্ত্রীর
২০২১ সালে মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থানের সফল দৃষ্টান্ত হিসেবে শেনচেন ম্যানগ্রোভ বনের সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রাকৃতিক সম্পদ মন্ত্রণালয় ও বিশ্ব প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়ান (আইইউসিএন) যৌথভাবে প্রকাশিত ‘প্রকৃতি ভিত্তিক সমাধান পরিকল্পনা-চীনের অনুশীলনের সাধারণ কেস’ এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পাশাপাশি, হ্য লান পাহাড়ের প্রকৃতি সংরক্ষণ, ইউন নান প্রদেশের ফু সিয়ান হ্রদ-বিধৌত এলাকার প্রশাসনসহ নয়টি প্রকল্প এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ প্রকল্পগুলো চীনের পূর্ব, মধ্য ও পশ্চিম অঞ্চলে রয়েছে এবং এসব হচ্ছে সেখানকার প্রকৃতি, কৃষি ও শহরসহ নানা ধরনের বাস্তুতন্ত্র।
হ্য লান পাহাড়কে ‘পিতা পাহাড়’ বলে ডাকে কান সু প্রদেশের মানুষরা। কারণ সেখানে রয়েছে প্রচুর কয়লা, সিলিকা সম্পদ। গত শতাব্দীর ৫০-এর দশক থেকে বড় আকারের মাইনিং শিল্প গুরুতরভাবে স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই হ্য লান পাহাড়ের পরিস্থিতি পরিবর্তন করা দরকার হয়।
২০১৭ সালে হ্য লান পাহাড়ের প্রকৃতি পুনরুদ্ধার প্রকল্প আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। পাহাড়ে পরিত্যক্ত খনিতে আঙ্গুর রোপণ করা হয় এবং আঙ্গুর বাগানের ভিডিত্তে ওয়াইন ও পর্যটন শিল্পের দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে। ২০২০ সালে চীনে প্রকাশিত হয় গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের পরিকল্পনা ২০২১-২০৩৫। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী,কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিবছর ১০ বিলিয়ন ইউয়ান বরাদ্দ দেয় পাহাড়, বন, হ্রদসহ নানা প্রকল্পে।
আরও পড়ুন… চীন-মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বালি দ্বীপে বৈঠক
কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ছাড়া, স্থানীয়রাও নিজেদের মানুষ-প্রকৃতি সহাবস্থানের নতুন ব্যবস্থা আবিষ্কার করে। চেন চিয়াং প্রদেশের লি সুই শহরে ধারাবাহিক সার্কুলার জৈব কৃষি প্রকল্প প্রাকৃতিক ভিত্তিকে পরিকল্পনা ও চীনের ঐতিহ্যিক প্রাকৃতিক সংস্কৃতিকে সংযুক্ত করে।
ছিং থিয়ান জেলার ইতিহাস ১৩০০ বছরের প্রাচীন এবং থাং রাজবংশ আমল থেকে ছিং থিয়ান জেলার পূর্বপুরুষরা পাহাড়ে ধান ও মাছ চাষের উপায় আবিষ্কার করেছেন। প্রতিবছরের এপ্রিল মাসে শুরু হয় বসন্তকালীন চাষ এবং ক্ষেত জলে ভরে যায়।
ধান রোপণের পাশাপাশি মাছও তখন জলে ছাড়া হয়। মাছ, ধান ক্ষেতের আগাছা নিধন, কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ, মাটি আলগা করে এবং ধান ক্ষেত মাছের জন্য মাইক্রোক্লাইমেট এবং ফিড সরবরাহ করে।দুটোই একসাথে বড় হয়। তবে সময়ের সাথে সাথে ঐতিহ্যিক এই পদ্ধতিও নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীণ হয়। বিশেষ করে চাল ভাল দামে বিক্রি হতো না বলে অনেক মানুষ আর ধান চাষ করতে চাইতো না।
২০১৭ সালে জেলায় শুরু হয় ধান ও মাছের সহাবস্থানে জৈব কৃষি প্রকল্প। ছিং থিয়ান জেলা সরকারের উদ্যেগে ছিং থিয়ানের ধান একটি মধ্য-উচ্চ ব্র্যান্ড হিসেবে বাজারে প্রবেশ করে।
ধান ও মাছের সহাবস্থান প্রকল্প চালু হবার পর প্রতিমু (৬৬৭ বর্গমিটার) জমিতে সার ব্যবহারের পরিমাণ ৪০ শতাংশ, কীটনাশক ব্যবহারের পরিমাণ ৬০ শতাংশ কমে। নিড়ানির কোন খরচ হবে না কারণ ধান ক্ষেতে মাছ এ কাজ করে এবং মাছ বিক্রি হলে আরও টাকা উপার্জন করতে পারে স্থানীয় কৃষকরা।
আরও পড়ুন…মানবাধিকারের বহুপক্ষবাদ জোরদারে চীনসহ ৩০ দেশের আহ্বান
অন্যদিকে, ইউন নান প্রদেশের লি সুই শহরের চিন ইউন জেলায় অনুরূপ প্রোগ্রাম আছে। তবে তাঁরা মাছ ও হাঁস জল বাঁশের সাথে লালন করে। প্রতিমু জল বাঁশের ক্ষেতে ৫টি হাঁস লালন করে। এ হাঁসগুলো পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করে। কারণ তারা পানিতে থাকা ডাকউইড এবং আগাছা খায় পাশাপাশি হাঁসের সার একটি উত্তম সার।
এই প্রকল্পের সাহায্যে সার ও কীটনাশকের ব্যবহারের পরিমাণ ৭০ শতাংশ কমে এবং প্রতিমু জমির আয় ৩০০-৫০০ ইউয়ান বেশি হবে। পাশাপাশি, কৃষি দূষণও অনেক হ্রাস পায়।
লি সুইর সার্কুলার জৈব কৃষি বা হ্য লান পাহাড়ের প্রাকৃতিক পর্যটন ও চাষ যাই হোক, তা স্থানীয়দের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। প্রকৃতির সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার একটি বৈশ্বিক ব্যাপার। মানুষ ও প্রকৃতিকর সহাবস্থান হল চীনের হাজার বছরের প্রাচীন দর্শন।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বার বার জোর দিয়ে বলেছেন, প্রাকৃতিক পরিবেশকে চোখের মতো রক্ষা করতে হবে এবং পরিবেশের সঙ্গে জীবনের মতো আচরণ করতে হবে। চীনের এই সফল অনুশীলন বিশ্ব ও চীনের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি পৃথিবীর নানা দেশে তাঁদের পরিকল্পনা প্রদানে বিশেষ ভুমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
ইবাংলা/মশিউর/১৪ই জুলাই,২০২২