বিয়ে এমন একটি সামাজিক বন্ধন, যা সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে শারীরিক সম্পর্কের অনুমতি দেয়। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে লিভ টুগেদার প্রথাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত। আমাদের দেশে আজকাল এ প্রথার উদাহরণ দেখা দিলেও তা সামাজিকভাবে গৃহীত নয়। আমাদের দেশের সমাজ লিভ টুগেদারকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফলে এই সম্পর্কে শারীরিক সম্পর্ক বিয়ের পূর্বের শারীরিক সম্পর্ক হিসেবেই গণ্য করা হয়।
পৃথিবীর সব ধর্মেই বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ককে নিষিদ্ধ করা হলেও ভারতের ছত্তীসগঢ়ে এমন একটি জাতি রয়েছে, যারা বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক করে থাকে। তারা ওই এলাকার আদি গোন্ড জনজাতির একটি উপজাতি। তাদেরকে ‘বাইসন হর্ন মারিয়া’ নামে ডাকা হয়। মাথায় বাইসনের শিং দিয়ে বানানো সজ্জার জন্যই এমন নামকরণ হয়েছে এই উপজাতির।
তাদের শিঙের ব্যবহারের জন্য এক সময় ইংরেজরাই নাকি এই নাম দিয়েছিল। এখন অনেকেই বন মহিষের বদলে হরিণ বা অন্য কোনো প্রাণীর শিং ব্যবহার করেন। কিন্তু নাম একই রয়ে গেছে।
ছত্তীসগঢ়ের জগদলপুরেই মূলত এই জনজাতিদের বাস। নারী-পুরুষের যৌন সম্পর্কের যে সংজ্ঞা এরা রচনা করেছেন, তা আজও বিস্মিত করে।
এই জনগোষ্ঠীর কারও কোনো পুঁথিগত শিক্ষা নেই। জীবনযাপনও অত্যন্ত সরল। বেশভূষায় তথাকথিত ‘সভ্য’ সমাজের ছাপ নেই। কিন্তু একটি বিষয়ে তথাকথিত ‘সভ্য’ এবং ‘শিক্ষিত’ সমাজের থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছেন তারা। আর তা হলো মানসিকতায়।
সমাজে নারী এবং পুরুষের সমানাধিকার নিয়ে সরব অনেকেই। কিন্তু প্রকৃত অর্থে নারী-পুরুষকে দাঁড়িপাল্লায় সমানভাবে রাখতে পারে হাতেগোনা কয়েকজনই। এই উপজাতির সমাজে কিন্তু এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। বছরের পর বছর ধরে পুরুষের সঙ্গেই তাল মিলিয়ে চলেন এই সমাজের নারীরা।
তাদের বিশ্বাস, বিয়ের আগে নারী এবং পুরুষের মধ্যে যৌন সম্পর্ক গড়ে ওঠা আবশ্যিক। এর মাধ্যমেই পরবর্তীকালে দাম্পত্যের বন্ধন আরও অটুট হবে, মনে করেন তারা।
পুরুষ বা নারী যদি সেই সম্পর্কে খুশি না হয়ে থাকেন তা হলে যেকোনো সময় তারা সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন বিনা বাধায়। একে অপরের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে খুশি হলে তবেই তাদের বিয়ে দেওয়া হয়। আবার বিয়ের পরও যদি কারও অন্য কোনো নারী বা পুরুষকে ভালো লেগে থাকে, সে ক্ষেত্রেও বিনা বাধায় দাম্পত্য ভেঙে বেরিয়ে আসার স্বাধীনতা রয়েছে।
এই উপজাতির মানুষ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, ভালোবাসা না থাকলে সেই সম্পর্ক বয়ে নিয়ে চলার কোনো অর্থ নেই। সঙ্গীকে ছেড়ে অন্য সঙ্গী বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা নারী-পুরুষ উভয়েরই সমান রয়েছে। বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কে কোনো নারীর সন্তান হলে, তাকেও খুব স্বাভাবিকভাবেই আপন করে নেয় পুরো পরিবার।
কোনো নারীর স্বামীর মৃত্যু হলে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরাই তার জন্য পাত্র খোঁজেন। ধুমধাম করে বিধবা বিবাহের আয়োজন হয়। এক বিশেষ ধরনের উৎসব রয়েছে তাদের। যেখানে ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত অবস্থায় পুরুষ ও মহিলারা উল্লাসে মাতেন। তারা একে অপরকে নানা বিদ্রুপও করেন। কিন্তু তা কখনও মাত্রা ছাড়িয়ে যায় না। এখানে ‘সভ্যতা’র মাপকাঠি একেবারে অন্য। যৌনতার এক স্বাধীনতা এখনও আছে এই জনজাতির মধ্যে।
১৯৩৮ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ আমলা ডাব্লিউভি গ্রিগসনের একটি বইয়ের সূত্র ধরে গোন্ডদের এই অংশের জনজাতিকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। গ্রিগসনের লেখা ‘দ্য মারিয়া গোন্ডস অফ বস্তার’ দীর্ঘ দিন ধরে বিশ্বের নামী বিশ্ববিদ্যালগুলোর পাঠ্যক্রমে রয়েছে। সেই বইকে ধরেই যাচাই করে দেখা গিয়েছে, এখনও সেই সব নিয়ম মেনেই চলে এই জনজাতি।
তবে এই জনজাতির কথা যত ছড়িয়েছে তাদের জীবনযাত্রা দেখতে ভিড় বেড়েছে পর্যটকদের। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ক্রমে শহুরে সভ্যতা ও বিদেশি পর্যটকদের ভিড় এই জনজাতির মানুষের মনে অন্য রকম প্রভাব ফেলতে পারে।
ইবাংলা/এএমখান/নাঈম/০৯নভেম্বর, ২০২১