কর্মক্ষেত্রে নারী হয়রানি বাড়ছে

মনিরা তাবাস্সুম

দুদিন ধরে অফিসে যাচ্ছেন না নাহার। পরিবারের কেউ কারন জানতে চাইলে শরীর খারাপের অজুহাত দিচ্ছে। কারো সঙ্গে তেমন কথাও বলছে না। দুদিন আগে অফিসে ঘটে যাওয়া এক অপ্রীতিকর ঘটনা কিছুতেই মন থেকে মুছতে পারছে না সে।

একটি মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানে কাজের সুবাদে বেশ হাই প্রোফাইল ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয় তার। এমনই এক অফিসিয়াল মিটিং এর এক পর্যায়ে ক্লায়েন্ট তাকে নানা ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলার এক পর্যায়ে গায়েও হাত দেন। নিজ অফিসে এমন ঘটনার শিকার হয়ে মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরেছে সে। সিদ্ধান্ত নিয়েছে চাকরিটি আর করবে না সে।

শুধু নাহার নয়, কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই এমন হয়রানির শিকার হতে হয় নারীকর্মীদের। কখনও শারীরিক, কখনও মানসিক। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের পরিসংখ্যানটা দিন দিন বাড়ছে। পুরুষের পাশাপাশি নিজেকে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও নিরাপত্তা নিশ্চিতের জায়গাটিতেই নারী এখনও দূর্বল।

কর্মস্থলে মানসিক ও যৌন হয়রানির ঘটনা নতুন নয়। বিভিন্ন পেশায় নিয়জিত নারীদের কাছে জানতে চাওয়া হয় কর্মক্ষেত্রে সাধারনত কি ধরনের হয়রানির শিকার হন তারা। তাদের ব্যক্তব্যেই উঠে আসে নির্যাতনের বিভিন্ন দিক।

প্রায় প্রতিটি নারীই কোন না কোন সময় কর্মক্ষেত্রে অকারনে শরীর স্পর্শ, কথা বলার সময় অশালীন শব্দ উচ্চারণ, শারীরিক গঠন বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে মন্তব্য, পোশাক নিয়ে অপ্রীতিকর মন্তব্য,ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলা ইত্যাদির মুখোমুখি হন। তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে জরিত নারীরা সবচেয়ে বেশি এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হন।

অষ্ট্রেলিয়ান ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের আর্থিক সহায়তায় ‘কর্মজীবি নারী’ নামের একটি সংগঠন ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং কেয়ারের সহায়তায় বিভিন্ন পোশাক কারখাণায় ১৫০ নারী শ্রমিকের মধ্যে একটি গবেষণা পরিচালনা করে। এ গবেষনায় যে চিত্র উঠে আসে তা অনেকটা এরকম- তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমীকদের প্রায় ১৩ ভাগ যৌন হয়রানির শিকার। তবে এর সংখ্যা যে আরো বেশি তা অজানা নেই কারোই। শারীরিক নির্যাতনের শিকার ২০ ভাগ। মানসিক নির্যতিনের শিকার ৭১ ভাগের ও বেশি। তারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন সুপারভাইজারের দ্বারা।

করোনা মহামারিকালীন চলতি বছরের জুলাইয়ে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল ও গার্লস অ্যাডভোকেসি অ্যালায়েন্সের সহায়তায় এক জরিপ পরিচালনা করে জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম। ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি বলেন,যৌন হয়রানি শিকার হয়েছেন এমন ১৩৫ জন কর্মজীবী নারী অংশগ্রহণ করেন এ গবেষণা কার্যক্রমটিতে। অংশগ্রহণকারী ১৩৫ জন নারীর শতভাগই নিজ কর্মস্থলে কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানান।

এদের মধ্যে ৬১ জন শারীরিক স্পর্শের মাধ্যমে (৪৫ দশমিক ১৯ শতাংশ), ৮০ জন মৌখিকভাবে (৫৯ দশমিক ২৫ শতাংশ)। সরাসরি যৌন আবেদনের শিকার হয়েছেন ৬৪ জন অর্থাৎ ৪৭ দশমিক ৪১ শতাংশ নারী। এ ছাড়া ৬০ জন (৪৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ) সুপারভাইজার দ্বারা, ৮৮ জন (৬৫ দশমিক ১৯ শতাংশ) ম্যানেজার/বস কর্তৃক, আটজন (৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ) নারী তাদের নিয়োগকর্তার দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন।

শুধু বাংলাদেশে নয় ,সারা বিশ্বে নারীদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে দিন দিন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বা আইএলও বলেছে, নারীর প্রতি লিঙ্গ বৈষম্য এবং মানবাধিকার লঙ্ঘেনের একটি সুস্পষ্ট প্রমান হচ্ছে কর্মস্থলে যৌন হয়রানি। তাদের মতে ইউরোপিয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ নারীই কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার। দিন দিনই যে এ পরিসংঙ্খান বৃদ্ধি পাচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু এখন পর্যন্ত কর্মস্থলে এসব হয়রানির বিষয়গুলো খুব বেশি প্রকাশ পায় না। আর এ বিষয়গুলো প্রকাশ্যে না আসার কারন হিসেবে বলা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীর সংকোচ, চাকরি হারোনোর ভয়,মান সন্মানের ভয় এবং পারিবারিক মর্যদা ক্ষুন্ন হওয়ার ভয়।

হাইকোর্ট কতৃক প্রনীত এক নীতিমালায় বলা হয় যে- কর্মক্ষেত্রে স্ব স্ব নিযোগকর্তার তত্বাবধায়নে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠণ করতে হবে, যার বেশিরভাগ সদস্য হবেন নারী। কোন রকম আপত্তিকর ঘটনা ঘটার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিটির কাছে অভিযোগ পেশ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হল অনেক প্রতিষ্ঠানই এখনো এই নীতিমালা সমন্বিত করেনি। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও বেশ উদাসীন।

যতদিন নারীর জন্য নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ তৈরী না হচ্ছে ততদিন কর্মক্ষেত্রে প্রতিটি নারীকে আরো সচেতন হতে হবে। যৌন নিপীড়নের মত ঘটনাগুলো গোপন না রেখে, অপরাধিকে প্রশ্রয় না দিয়ে শাস্তির আওতায় আনার জন্য সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন।

ইবাংলা/টিপি/১৮ নভেম্বর২০২১

Contact Us